মাঝের সেই দিনগুলো #৩
দুপুরবেলা খেয়েদেয়ে সবে একটু শুয়েছি এমন সময় বালিশের পাশে রাখা ফোনটা বেজে উঠল । এই সময়ে বিশেষ কেউ ফোন করেনা আর করলেও আমি ফোন তুলিনা কিন্তু তবুও আজকে কি মনে হতে ফোনটা রসিভ করার জন্য নিজের হাত বাড়ালাম আমি। সেই শোয়া অবস্থাতেই কোন ভাবে এইদিক ওইদিক হাতড়ে ফোনটা নিজের চোখের সামনে ধরতেই স্ক্রিনে মিমির নাম দেখতে পেলাম আমি। 'মিমি, এই সময়ে হঠাৎ কেন ফোন করছে...?' নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করে উঠলাম আমি । যাইহোক আর বিলম্ব না করে কলটা রিসিভ করলাম আমি আর সেটা করতেই ফোনের ওপাশ থেকে মিমির গলার আওয়াজ ভেসে এলো ঃ
"কিরে প্রিয় ঘুমচ্ছিলি নাকি? ঘুম ভাঙিয়ে দিলাম না কি তোর?"
"না...না, আমি জাস্ট শুলাম এইমাত্র, তবে তুই এখন হঠাৎ ফোন করছিস কেন...?" গলায় একটা বিরক্তিসূচক ভাব এনে প্রশ্ন করলাম আমি ।
"কেন? আমি কি তোকে ফোন করতে পারি না ? ফোন করে জিজ্ঞেস করতে পারিনা তুই কেমন আছিস...? "
"না সে সব নয়, হ্যাঁ ভালো আছি...তুই ভালো আছিস আর এছাড়া কি জন্য ফোন করলি তুই "
আমার কথাটা শেষ হতেই ফোনের ওইপাশের ব্যেক্তিটি হঠাৎ একদম নিস্তব্ধ হয়ে গেল । মিমির থেকে আর কোনও উত্তর না পেয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর আমি বললাম " হ্যালো মিমি, তুই আছিস না গেছিস...?" এমন সময় মিমি হঠাৎ বলে উঠল ঃ
"প্রিয়, তুই কিন্তু ঠিক করলি না..."
"মানে...?"
"তুই একবার অন্তত ভেবে দেখতে পারতিস...প্রিয়"
"মানে? কি বলছিস...? কি ব্যাপারে কি ভেবে দেখতাম...?" আমি চেষ্টা করতে লাগলাম মিমির সেই অজানা ব্যাপারটার কথা মনে করতে ।
"তুই একবারেই না যেনে না শুনে ওইরকম না বলে দিলি, আমি অনেক আশা করে কাকীর কাছে তোর জন্য ওই বিয়ের সম্বন্ধটা নিয়ে গিয়েছিলাম...প্রিয় তুই যদি একবার..."
"না, একদম না" শক্ত গলায় বলে উঠলাম আমি
"কিন্তু কেন প্রিয়, তুই প্লিজ একবার ওর সঙ্গে...দেখা করে দ্যাখ...প্লিজ সোনা..."
"ওইরকম ব্লেটেনটলি তেল মারলে হবে না মিমি, তোর এসব মায়ের সঙ্গে কথা বলতে যাওয়ার আগে ভাবতে হত আর তার চেও বড় কথা...তুই তো আমাকে অনেক অনেকদিন ধরেই চিনিস, তাহলে? তাহলে কেন তুই একবার আমাকে জানালি না ? আমাকে ডিঙিয়ে মায়ের কাছে যেতে তোকে কে বলেছিল?"
"মানছি প্রিয়... আমি মানছি যে আমি ভুল করেছি, অ্যাই এম রিয়েলি সরি বাট প্লিজ...ফর ওয়ান্স, প্লিজ রিকন্সিডার দিস সোনা। আমার ওপরের রাগটা ওর ঘাড়ে প্লিজ চাপাস না, মেয়েটা খুবই ভালো জানিস তো...আর আমি ওকে পার্সোনালি চিনি...ও "
"ফার্স্ট অফ অল, আমাকে ওইরকম সোনা সোনা বলা বন্ধ কর মিমি। তোর বাড়িতে তোর বর আছে তো, তো তাকেই বরঞ্চ সোনা মনা বলে সম্বোধন কর আর সেকেন্ডলি অ্যাই ডোন্ট কেয়ার মিমি... অ্যাই ডোন্ট কেয়ার অ্যাবাউট হার অ্যাট অল। তোর যদি এ ছাড়া অন্য কোনও কথা বলার না থাকে তাহলে এবার আমি ফোনটা রাখছি , আমার খুব ঘুম পেয়েছে...টাটা"
"না না প্রিয়, দাড়া ফোনটা কেটে দিস না...দাড়া" তবে মিমি আর কিছু বলার আগেই আমি ফোনটা কেটে দিলাম তবে পরমুহুরতে মিমিকে এতদিন ধরে চেনার পর ওর স্বভাবটা মনে পড়তেই বুঝলাম সে হয়তো একটু আবার ফোন করবে । দিনদুপুরে এই একই ঘ্যানঘ্যানানি শুনতে আর একদম ইচ্ছে করছিল না, তাই বাধ্য হয়ে ফোনটা সাইলেন্ট মোড করে বালিশের পাশে রেখে দিলাম আমি । শুয়ে শুয়ে চিন্তা করতে লাগলাম যে মিমির সাথে ওই রকম খারাপ ব্যাবহার করে ঠিক করলাম আমি। ওই মেয়েটাই আমার সংকটের সময়ে নিঃস্বার্থ ভাবে আমার পাশে ছিল । আমার জীবনের সব থেকে কাছের বন্ধু ও, কিন্তু পরক্ষনেই আমায় ডিঙিয়ে মায়ের কাছে যাওয়ার ব্যাপারটা মনে পড়তে আমার মনের মধ্যে থেকে সেই 'কিন্তু কেনর' মেঘ কেটে গেল ।
চোখটা সবে একটু লেগেছে এমন সময় বালিশটা হঠাৎ কেঁপে উঠল আর এই আচমকা কম্পনের চোটে আমার কাঁচা ঘুমটা ভেঙে গেল । বুঝলাম আবার নিশ্চয়ই মিমি ফোন করেছে তাই আবার সেই আগের মতনই ফোনটা তুলে নিজের আধ খোলা আধবন্ধ চোখের সামনে ধরলাম আমি । তবে এইবার একটা অচেনা নাম্বার থেকে ফোন এসেছে আমার কাছে । অজানা অচেনা নাম্বার দেখে কলটা রিসিভ করতে না চাইলেও, রিসিভ কলে অজান্তেই নিজের আঙুল ঠেকে যেতেই ফোনের স্পিকার থেকে একটা ক্ষীণ কণ্ঠস্বর ভেসে এলো আমার কানে । আমি কোনো মতে আস্তে আস্তে ফোনটাকে নিজের কানের কাছে নিয়ে যেতেই বুঝলাম যে সেটা কোন মহিলার কণ্ঠস্বর...
"হ্যালো" ওই পাশ থেকে বলে উঠল সেই ব্যক্তি
"হ্যাঁ হ্যালো, কে বলছেন?"
"বাবা! কে বলছেন? একেবারে আপনি দিয়ে শুরু করলে যে তুমি..."
"হ্যালো...হ্যাঁ মানে? কে বলছেন আপনি, কাকে চাই ?" আমি বললাম
"আরে আমি বলছি গো বাপু, আমি । চিন্তে পাচ্ছ না বুজি...?"
"না, আপনি কে...কাকে চান?"
"এ বাবা, তাহলে কি আমি ভুল জায়গাতে ফোন করলাম নাকি? কিন্তু বাপু সেইদিন তো এই নাম্বারটাই লিখে দিয়েছিলে সেই কার্ডটায়, তাহলে কি ভুল লিখেছিলে তুমি? তবে রোজ ঘড়ি ধরে ঠিক আটটা নাগাদ লুকিয়ে লুকিয়ে আমাকে দেখার সময় তো তুমি এরকম ভুল করোনা..."
মহিলাটির মুখের সেই কথা আমার কানের মধ্যে দিয়ে মস্তিষ্কে পৌঁছতেই তার পরিচয়টা জলের মতন পরিষ্কার হয়ে গেল আমার কাছে । চোখের সব ঘুম কোথায় যেন উরে গেল আমার আর সাথে সাথে সোজা হয়ে বিছানায় উঠে বসে আমি বলে উঠলাম "বো...বৌদি, তুমি ?"
"হ্যাঁ গো বাপু, বাপরে এতক্ষণ লাগে বুঝতে তোমার? কিন্তু এতক্ষণ ধরে ওইরকম চিনি না জানি না করছিলে কেন গো...আমার সাথে এখন কথা বলতে ইচ্ছা করছে না নাকি ?" বৌদি বলল
"না না ইচ্ছা...ইচ্ছে করবে না, তাই আবার কখনও হয় নাকি ? আসলে আমি একটু ঘুমিয়ে পরেছিলাম তাই...বুঝতে"
"ইসসস এ-বাবা বেচারি, তোমার কাঁচা ঘুমটা আমি ভাঙিয়ে দিলাম তো...?"
"না না, ঘুম তো রোজের ব্যাপার চাইলেই আসবে তবে এবার বলও কি বলবে তুমি..."
"যা চলে, তুমি তো নিজেই আজকে সকালে ইশারা করে আমাকে ফোন করতে বললে...আবার এখন"
"হ্যাঁ" বৌদিকে থামিয়ে বলে উঠলাম আমি, "আসলে সামনা সমনি আমাদের কোনো কথা হয়না তো তাই..."
"বুঝেছি, তবে পাশাপাশি বেশি কথা না বলাই ভালো আর সেই জন্যই আগবারিয়ে তোমার সাথে পরিচয় করতেই ফোনটা করলাম আমি, তবে এবার তুমি কি বলবে বলছিলে...?"
"হ্যাঁ, আচ্ছা তুমি কোথায় আছো এখন ?"
"আমি? আমি তো এই নার্সিং হমেই রইছি। আমার শিফট এই শেষ হল বলে, তাই ভাবলাম এই ফাঁকে তোমার সাথে একটু কথা বলি "
"ওহ, কোন নার্সিং হোম যেন ?"
"এই তো নিউস্টার পলি ক্লিনিক, কেন বল তো...তুমি আসবে নাকি ? বৌদি প্রশ্ন করল ।
"হ্যাঁ যাওয়ার তো একটা পরিকল্পনা ছিল তবে শুধু তুমি বললে তবেই যেতে পারি...আর গেলে একটু ভালো করে গল্পগুজব করতে পারতাম আমরা..."
" হ্যাঁ সে এসো না। এলে গল্প তো হবেই তাছাড়া আমার আড্ডা দিতে খুব ভালো লাগে, তবে আজকে আসতে পারবে তুমি? ফাঁকা আছো ? ফাঁকা না থাকলে না হয় অন্যদিন এসো" শেষের বাকটা বলতেই ফোনের ওপর প্রান্ত থেকে বৌদির বুকের সেই দীর্ঘশ্বাসটা শুনতে পেলাম আমি । মনে হল যেন খুব হতাশ সে ।
"না না, আমি আজকে একদম ফাঁকা আছি"
"ওহ তাই! ঠিক আছে তাহলে আজই চলে এসো তুমি" বৌদির গলার স্বরে পরিবর্তনটা উপলব্ধ করলাম আমি ।
"আচ্ছা তাহলে নার্সিং হোমের পাশ থেকে তোমায় সাথে দেখা করে নেব তো নাকি ? "
"না না, খেপেছ নাকি? একদম না..."
"কেন...?"
"আমার ভয় করে..."
"কিসের ভয়...? কার ভয়...? আমি তো থাকব তোমার সাথে..."
"সেইটারই তো ভয় । তোমার সাথে থাকাকালীন যদি চেনা কারোর সাথে মুখোমুখি হয় আমার, তাহলে...ভয় করে খুব । তুম...তুমি তো জানোই আমি বিবাহিত তাই...." বলে থেমে গেল বৌদি, তারপর আবার বলে উঠল ," আর তাছাড়া তোমার থেকে আমি বয়সে অনেকটাই বড় তাই আমাকে নিজের বান্ধবী বলেও পরিচয় দিতে পারবে না তুমি..."
"হমম ঠিকই বলেছ তুমি, কিন্তু তোমায় বান্ধবী না বলে তোমাকে বৌদি বললে কি অসুবিধা হবে? কিন্তু তার আগে তোমা..." বলতে গিয়ে থেমে গেলাম আমি ।
"হ্যাঁ...বোলো?"
"তোমাকে কি বলে ডাকব আমি তাহলে...?"
"তোমার যেটা ভালো মনে হয় সেটা বলেই ডেকো, আমার কিছুতেই কিছু অসুবিধে নেই । ইচ্ছা হলে নাম ধরেও ডাকতে পাড়, তাতেও আমার কোনো অসুবিধে নেই..."
"হ্যাঁ সে না হয়...হল, তবে বৌদি...তোমার নাম...তোমার নাম কি?"
"এ মা, এতদিন ধরে আমাকে ঝাড়ি মারার পরেও আমার নাম জানতে পারলে না তুমি? আচ্ছা ঠিক আছে, তাহলে আমিই বলে দি, আমার নাম রেখা..."
"বাঃ সুন্দর নাম..."
"ধাত...ওরকম মনে হয় । রোজ যখন এই একই নামে লোকেরা তোমাকে ডাকে তখন এইটাই একঘেয়ে হয়ে যায়..."
"সেটা ঠিকি বলেছ তুমি আর বৌদি তুমি কি ওই সকালেরই ড্রেসে আছো তো?"
"হ্যাঁ মানে না । আসলে এখন ইউনিফর্ম পরে আছি আমি, এই একটু পরে শিফটটা শেষ হয়ে গেলেই আবার পালটে নেব । তবে রোজ রোজ ওটা পড়তে পারবো না গো । তুমি বললে তাই জন্যই এইটা পড়েছি আমি..." বৌদি বলল
"ওহ! থ্যাঙ্ক ইয়উ..." *'থ্যাঙ্ক ইয়উ? থ্যাঙ্ক ইয়উ কি করতে বলতে গেলাম আমি...?'
"আচ্ছা, তাহলে এখন ফোনটা রাখি...?"
"আরে রে বৌদি দাড়াও, কোথায় দেখা করবে সেটা তো বললেই না আমাকে..." তাড়াহুড়ো করে বলে উঠলাম আমি ।
"ওহ বাবা! দেখেছ তো ভুলেই গেছি আমি...তুমি না ওই ঠিক সারে পাঁচটার সময় টিটি সেন্টারের সামনে চলে এসো, আমি ঠিক পৌঁছে যাব..." ।
"একদম...আমি তার আগেই পৌঁছে যাব..."
"আচ্ছা, আর তোমার নামটা তো আমায় বললে না এখনও..."
"হমমম, সেটা গিয়ে বলব ক্ষণ..."
"হম" । বৌদি ফোনটা রাখতেই মনটা আবার আগের দিনের মতন নেচে উঠল আমার । তাহলে শেষমেশ এত মাসের পরিশ্রমের পর আমি বৌদির সাথে দেখা করতে চলেছি...। বৌদিকে লাগানোর প্রথম ধাপে উত্তীর্ণ হয়ে এতোটাই এক্সাইটেড হয়ে পরলাম আমি যে আর ঘুম এলোই না একদম। বিছানা থেকে নেমে আরেকবার স্নান করে ফ্রেশ হয়ে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বসে রইলাম আমি, সারে চারটে বাজার অপেক্ষায় ।
ঠিক সারে পাঁচটা নাগাদ টিটি সেন্টারের সামনে পৌঁছে গেলাম আমি। বাইক থাকার এটাই সুবিধা মনে করি আমি তবে আজ শনিবার হওয়ায় অন্যদিনের তুলনায় অফিসের ভিড়টা নিতান্তও কম ছিল । তবে কলকাতা সব সময়ই জমজমাট । সেন্টারের নিচের পারকিংএ বাইকটা রেখে অধীর আগ্রহে বৌদির জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম আমি । ঘড়িতে আধ ঘণ্টা আদ ঘণ্টা করে অনেক সময়ই পার হয়ে যেতে লাগল । মাঝে আবার মনেও হল যে হয়তো সে আজ আসবে না কিন্তু তবুও নিজের আশা জাগিয়ে রেখে সেই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম আমি।
ফুটপাথ দিয়ে হেটে যাওয়া সব পথচারীর মধ্যে রেখা বৌদিকে খুঁজতে লাগলাম আমি, এমন সময় হঠাৎ দেখি না সত্যিই বৌদি হন্তদন্ত হয়ে এইদিকেই হেটে আসছে । বৌদিকে আসতে দেখে আমার মনে নিভে যাওয়া সেই আশার বাতিটা আবার জ্বলে উঠল । বৌদিও হয়তো আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নিজের হাটার গতি কমিয়ে মাথা নিচু করে আস্তে আস্তে আমার পাশে এসে দাঁড়াল ।