- 4
- 0
- 2
প্রিভিউ
ঢাকার অভিজাত এক শান্ত পাড়ায়, তিনতলা সাদা রঙের পুরনো নকশার একটি বাড়ি দাঁড়িয়ে আছে রাজসিক ভঙ্গিতে। প্রবেশপথের লোহার গেট পেরিয়ে ঢুকলেই, পাকা পথ ধরে ফুলে ভরা ছোট্ট বাগান—গোলাপ, জুঁই আর বেলির গন্ধ মিশে থাকে বাতাসে। ভেতরে উঠোনের একপাশে গাড়ি রাখার শেড, অন্যপাশে রান্নাঘরের ছোট্ট পেছনের দরজা।
এই বাড়িতে থাকে চারজনের এক স্নিগ্ধ সংসার।
রিয়া (২৪)—শহরের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করা এক মার্জিত, নরম স্বভাবের তরুণী। তার হাসি যেমন শান্ত, তেমনি চোখে লেগে থাকে এক অদৃশ্য মায়া। বিয়ের আগে জীবন কেটেছে আরাম আর স্নেহের ছায়ায়। বিয়ের ছয় মাস পেরোলেও রাতুলকে নিয়ে তার নতুন সংসারের আবেগ এখনও টাটকা। ঘরের সাজসজ্জা থেকে শুরু করে রান্নার আয়োজন—সবখানেই রিয়ার সূক্ষ্ম রুচির ছাপ মেলে।
রাতুল (২৭)—স্মার্ট, আত্মবিশ্বাসী, বাবার ব্যবসা সামলানোর পাশাপাশি নতুন নতুন পরিকল্পনায় ব্যস্ত থাকে। অফিসের বাইরে রিয়াকে সময় দেওয়ার চেষ্টা করে, আর দুজনের মিলের কারণে তাদের সম্পর্ক সহজ আর নির্ভেজাল।
মো. আজিম (৬২)—পরিবারের কর্তা, শান্ত কিন্তু দৃঢ় ব্যক্তিত্বের মানুষ। ব্যবসায় অভিজ্ঞ, কথায় কম কিন্তু কাজে মনোযোগী। ছেলেকে দায়িত্ব শিখিয়ে দিতে চান, তবে মাঝে মাঝে পুরনো দিনের স্মৃতিতে হারিয়ে যান।
নাজমা বেগম (৫৫)—গৃহিণী, পরিবারের মমতার কেন্দ্র। রিয়াকে নিজের মেয়ে মনে করে, তার প্রতি যত্নে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য নেই। রিয়ার জন্য প্রিয় খাবার বানানো থেকে শুরু করে শাড়ির রঙ বাছাই—সবকিছুতেই তিনি মাতৃসুলভ আন্তরিকতা দেখান।
হরিশ (৫৬)—এই পরিবারের ড্রাইভার। গায়ের রং খুবই কালো, কিন্তু লম্বা ও শক্তসমর্থ গড়ন। গ্রামের মানুষ, সেখানেই বউ-বাচ্চা থাকে; বড় মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। বেশি কথা বলে না, কিন্তু আচরণে এক ধরনের গম্ভীরতা আর অভ্যন্তরীণ রহস্য লুকিয়ে থাকে।
লতা (৩৮)—গৃহকর্মী। চটপটে, মুখে সবসময় ব্যস্ত ভাব, তবে মাঝে মাঝে ফাঁক পেলেই গসিপে মাতেন। হরিশের সাথে তার সম্পর্ক শুধুই পরিচিতি নয়—একই গ্রামের হওয়ার কারণে দীর্ঘদিনের সখ্য আছে, আর গোপনে তারা একে অপরের কাছে আরও ঘনিষ্ঠ। লতাই একসময় হরিশকে এ বাড়িতে কাজের জন্য নিয়ে আসে।
পর্ব ১
সকালের আলো বড় জানালা দিয়ে ডাইনিং রুমে ঢুকে পড়েছে। সাদা পর্দা হালকা বাতাসে দুলছে, আর টেবিলের উপর রাখা কাচের জগে কমলার রসের রঙ যেন আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। চারজনের সাজানো টেবিল—তাজা পরোটা, ডালপুরি, ডিম ভাজি, আর নাজমা বেগমের হাতে বানানো খাস্তা আলুর চপের গন্ধ চারপাশে ছড়িয়ে আছে।
লতা ব্যস্ত ভঙ্গিতে প্লেটে নাস্তা তুলে দিচ্ছে।
— “বড় সাহেব, এই নিন আপনার চপটা… আর আপার জন্যে ডালপুরি।”
রাতুল পরোটা কেটে রিয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
— “এই যে ম্যাডাম, গতকাল কিন্তু আমি তিনবার বলেছিলাম লবণটা কম দিতে… তাও—”
রিয়া সঙ্গে সঙ্গে ভ্রু কুঁচকে ন্যাকামি ভঙ্গিতে বলল,
— “মা… দেখেন তো, কেমন খুঁত ধরা শুরু করেছে!”
নাজমা বেগম হাসি চেপে রাখলেন না।
— “খবরদার, আমার বৌমাকে নিয়ে একটাও কথা বলবি না! আমার বৌমা সেরা।”
রাতুল মুখে হাসি রেখে মায়ের দিকে তাকাল,
— “আচ্ছা আচ্ছা… এখন তো মনে হচ্ছে আমি একা হয়ে গেলাম এই সংসারে।”
সবার হাসির মধ্যে হঠাৎ বাইরের গেট থেকে ধাতব শব্দ শোনা গেল। তারপর ধীর পায়ের শব্দ, আর এক মুহূর্ত পরেই দরজার পাশে দাঁড়াল এক লম্বা, গাঢ় কালো মানুষ। তার মুখে অদ্ভুত গম্ভীরতা, চোখে গভীর দৃষ্টি। ধুলো লাগা নীল শার্ট, হাতের আঙুলে পুরনো সোনালি আংটি।
সবার দৃষ্টি একসঙ্গে তার দিকে ঘুরে গেল।
লতা থেমে গিয়ে দরজার দিকে তাকাল, তারপর হাসিমুখে বলল,
— “বড় মালিক, আপনি যে আনতে বলেছিলেন… এই হরিশ। আমাদের গ্রামের মানুষ।”
মো. আজিম চশমার ফাঁক দিয়ে মানুষটাকে মাথা থেকে পা পর্যন্ত লক্ষ্য করলেন।
— “হঁম… লম্বা তো বটে। ড্রাইভিং জানিস?”
হরিশ বিনম্র গলায় উত্তর দিল,
— “জানি, সাহেব। বিশ বছর গাড়ি চালাইছি।”
রিয়া চুপচাপ তার দিকে তাকিয়ে রইল, চোখে যেন একটু কৌতূহল। আর হরিশও, ভদ্রভাবে মাথা নিচু করলেও, এক মুহূর্তের জন্য তার কালো চোখ দুটো রিয়ার মুখে থেমে রইল।
ডাইনিং টেবিলে হঠাৎ যেন কিছুটা নীরবতা নেমে এলো—যেন নতুন কারও আগমনে ঘরের বাতাসেই বদল এসে গেছে।
পর্ব ২
সেদিন নাস্তার পরেই মি. আজিম বাইরে বেরোলেন হরিশকে নিয়ে। আঙিনায় দাঁড়িয়ে পুরনো সাদা মাইক্রোবাসটা দেখিয়ে বললেন—
— “চল, এক চক্কর দিয়ে আয় দেখি কেমন চালাস।”
হরিশ নীরবে দরজা খুলে ভেতরে বসল। লম্বা হাত দিয়ে স্টিয়ারিং ধরার ভঙ্গিতেই বোঝা যাচ্ছিল, সে গাড়ির সঙ্গে অপরিচিত নয়। ইঞ্জিন চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একধরনের মসৃণ শব্দ উঠল—যেন অনেক দিন ধরে সে এই গাড়িটাই চালিয়ে আসছে।
মি. আজিম সামনে বসে নির্দেশ দিচ্ছিলেন,
— “এখান দিয়ে ঘুর… হ্যাঁ, ব্রেকটা টিপে দেখ… ভালো, এবার রিভার্স কর।”
ড্রাইভিং টেস্ট শেষ হতেই আজিম কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন, তারপর গম্ভীর মুখে বললেন—
— “থাক, আর কাউকে খোঁজার দরকার হবে না।”
এরপর থেকে হরিশের সকাল শুরু হতো গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে গাড়ি মুছে, তেলের মাত্রা চেক করে, আর কখনো কখনো নাজমা বেগমকে বাজারে পৌঁছে দিয়ে। বিকেলে মি. আজিমের সঙ্গে ব্যবসার কাজে বের হতো, আবার সন্ধ্যায় রাতুলকে অফিস থেকে আনত।
রিয়া মাঝে মাঝে বারান্দা থেকে তাকিয়ে দেখত—গাড়ির দরজা খুলে দেওয়ার সময় হরিশ মাথা নত করে দাঁড়িয়ে থাকে, কথা কম বলে, কিন্তু কাজে ভুল করে না।
এক মাস এভাবেই কেটে গেল। ধীরে ধীরে হরিশ হয়ে উঠল পরিবারের একজন বিশ্বস্ত মানুষ।
নাজমা বেগম নিশ্চিন্ত মনে বলতেন—
— “হরিশ থাকলে গাড়ি নিয়ে আমার আর কোনো দুশ্চিন্তা নেই।”
লতাও খুশি—নিজ গ্রামের মানুষকে এনে কাজে লাগাতে পেরে যেন তার ভেতরে এক গোপন গর্ব। আর হরিশ… সব সময় দূরে দাঁড়িয়ে, চুপচাপ, কিন্তু পরিবারের প্রতিটি সদস্যের অভ্যাস, যাতায়াতের সময়—সব যেন ধীরে ধীরে মুখস্থ করে নিচ্ছে।
পর্ব ৩
সেদিন রাতটা অস্বাভাবিক নীরব ছিল। দেয়াল ঘড়ির কাঁটা তখন সাড়ে এগারো ছুঁইছুঁই, কিন্তু রাতুলের কোনো খোঁজ নেই। বিকেলে বের হওয়ার সময় বলেছিল— “আজ ফিরতে দেরি হবে, ঘুমিয়ে যেও।”
কিন্তু মোবাইলটা ভুলে রেখে গেছে টেবিলে—যার মানে যোগাযোগের কোনো উপায় নেই।
রিয়া সোফায় বসে টিভির পর্দায় ফাঁকা চোখে তাকিয়ে ছিল। মাথায় নানা চিন্তা ঘুরছিল—রাতুল ঠিক আছে তো? কোথায় গেল? গাড়ি নষ্ট হলো নাকি? বাইরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে, জানলার কাঁচে টুপটাপ শব্দ পড়ছে।
উপরে শ্বাশুড়ির রুম থেকে ভেসে আসছে নিয়মিত নাক ডাকার শব্দ—নাজমা বেগম একবার ঘুমিয়ে পড়লে সহজে জাগেন না। শ্বশুর তো ব্যবসার কাজে শহরের বাইরে।
ডুপ্লেক্স বাড়ির ভেতরে যেন এক অদ্ভুত ফাঁকা ভাব নেমে এসেছে। রিয়া উঠে দাঁড়াল। নিজের রুমের বারান্দা থেকে নিচে তাকিয়ে দেখল—গেটের বাইরে রাস্তাটা ফাঁকা, স্ট্রিটলাইটের আলোয় শুধু হালকা কুয়াশা ভাসছে।
কিছুক্ষণ দ্বিধা করে সে নিচের সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলো। নিচতলার একপাশে লতার ছোট্ট ঘর—দরজা বন্ধ, ভেতরে কোনো শব্দ নেই। অন্যপাশে, করিডরের শেষ মাথায় হরিশের ঘর। কাঠের পুরনো দরজাটা আধো আঁধারে দাঁড়িয়ে আছে, দরজার সামনে ছোট্ট বাল্ব জ্বলছে ম্লান আলোয়।
রিয়ার বুকের ভেতর কেমন এক ধরণের টান অনুভূত হচ্ছিল—চিন্তা, কৌতূহল আর একটুখানি দ্বিধা মিশ্রিত। সে হাত তুলে ধীরে ধীরে টোক টোক করে নক করল।
নীরবতা।
তারপর ভেতর থেকে ধীর কণ্ঠে গম্ভীর একটা শব্দ—
— “কেডারে?”
রিয়া হালকা গলায় বলল,
— “আমি… রিয়া। একটু দরজা খুলবেন?”
দরজার ভেতর থেকে তালার শব্দ, তারপর ধীরে ধীরে দরজা ফাঁক হলো। ম্লান আলোয় দাঁড়িয়ে থাকা হরিশের মুখে একরাশ ঘুমঘুম ভাব, কিন্তু চোখ দুটো অদ্ভুতভাবে সজাগ।
— “কী হয়েছেরে? রাতে কি হয়েছে, তোরা কি আমাকে কিনে নিয়েছিস?যখন ইচ্ছা তখন কাজ করব”
আসলে হরি ঘুমের মধ্যে কাওকে চিনে না, ঘুম কেও ডাক দিলে সে রেগে যায়।
রিয়া এক মুহূর্ত তার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকল, তারপর নিচু স্বরে বলল—
— “আপনি এভাবে কেন কথা বলছেন? রাতুল এখনো ফিরে নি, তাই আমি চিন্তা করছি।”
---”তোর স্বামী আমাকে বলেছে চলে আসতে, তার আজ বিদেশি পার্টির সাথে মিটিং।“
হরিশ রিয়ার সামনে গেইট বন্ধ করে দেয় জোরে। রিয়া খুব অপমানিত বোধ করে এবং রাগে সে ফায়ার হয়ে যায়।?
ঢাকার অভিজাত এক শান্ত পাড়ায়, তিনতলা সাদা রঙের পুরনো নকশার একটি বাড়ি দাঁড়িয়ে আছে রাজসিক ভঙ্গিতে। প্রবেশপথের লোহার গেট পেরিয়ে ঢুকলেই, পাকা পথ ধরে ফুলে ভরা ছোট্ট বাগান—গোলাপ, জুঁই আর বেলির গন্ধ মিশে থাকে বাতাসে। ভেতরে উঠোনের একপাশে গাড়ি রাখার শেড, অন্যপাশে রান্নাঘরের ছোট্ট পেছনের দরজা।
এই বাড়িতে থাকে চারজনের এক স্নিগ্ধ সংসার।
রিয়া (২৪)—শহরের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করা এক মার্জিত, নরম স্বভাবের তরুণী। তার হাসি যেমন শান্ত, তেমনি চোখে লেগে থাকে এক অদৃশ্য মায়া। বিয়ের আগে জীবন কেটেছে আরাম আর স্নেহের ছায়ায়। বিয়ের ছয় মাস পেরোলেও রাতুলকে নিয়ে তার নতুন সংসারের আবেগ এখনও টাটকা। ঘরের সাজসজ্জা থেকে শুরু করে রান্নার আয়োজন—সবখানেই রিয়ার সূক্ষ্ম রুচির ছাপ মেলে।
রাতুল (২৭)—স্মার্ট, আত্মবিশ্বাসী, বাবার ব্যবসা সামলানোর পাশাপাশি নতুন নতুন পরিকল্পনায় ব্যস্ত থাকে। অফিসের বাইরে রিয়াকে সময় দেওয়ার চেষ্টা করে, আর দুজনের মিলের কারণে তাদের সম্পর্ক সহজ আর নির্ভেজাল।
মো. আজিম (৬২)—পরিবারের কর্তা, শান্ত কিন্তু দৃঢ় ব্যক্তিত্বের মানুষ। ব্যবসায় অভিজ্ঞ, কথায় কম কিন্তু কাজে মনোযোগী। ছেলেকে দায়িত্ব শিখিয়ে দিতে চান, তবে মাঝে মাঝে পুরনো দিনের স্মৃতিতে হারিয়ে যান।
নাজমা বেগম (৫৫)—গৃহিণী, পরিবারের মমতার কেন্দ্র। রিয়াকে নিজের মেয়ে মনে করে, তার প্রতি যত্নে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য নেই। রিয়ার জন্য প্রিয় খাবার বানানো থেকে শুরু করে শাড়ির রঙ বাছাই—সবকিছুতেই তিনি মাতৃসুলভ আন্তরিকতা দেখান।
হরিশ (৫৬)—এই পরিবারের ড্রাইভার। গায়ের রং খুবই কালো, কিন্তু লম্বা ও শক্তসমর্থ গড়ন। গ্রামের মানুষ, সেখানেই বউ-বাচ্চা থাকে; বড় মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। বেশি কথা বলে না, কিন্তু আচরণে এক ধরনের গম্ভীরতা আর অভ্যন্তরীণ রহস্য লুকিয়ে থাকে।
লতা (৩৮)—গৃহকর্মী। চটপটে, মুখে সবসময় ব্যস্ত ভাব, তবে মাঝে মাঝে ফাঁক পেলেই গসিপে মাতেন। হরিশের সাথে তার সম্পর্ক শুধুই পরিচিতি নয়—একই গ্রামের হওয়ার কারণে দীর্ঘদিনের সখ্য আছে, আর গোপনে তারা একে অপরের কাছে আরও ঘনিষ্ঠ। লতাই একসময় হরিশকে এ বাড়িতে কাজের জন্য নিয়ে আসে।
পর্ব ১
সকালের আলো বড় জানালা দিয়ে ডাইনিং রুমে ঢুকে পড়েছে। সাদা পর্দা হালকা বাতাসে দুলছে, আর টেবিলের উপর রাখা কাচের জগে কমলার রসের রঙ যেন আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। চারজনের সাজানো টেবিল—তাজা পরোটা, ডালপুরি, ডিম ভাজি, আর নাজমা বেগমের হাতে বানানো খাস্তা আলুর চপের গন্ধ চারপাশে ছড়িয়ে আছে।
লতা ব্যস্ত ভঙ্গিতে প্লেটে নাস্তা তুলে দিচ্ছে।
— “বড় সাহেব, এই নিন আপনার চপটা… আর আপার জন্যে ডালপুরি।”
রাতুল পরোটা কেটে রিয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
— “এই যে ম্যাডাম, গতকাল কিন্তু আমি তিনবার বলেছিলাম লবণটা কম দিতে… তাও—”
রিয়া সঙ্গে সঙ্গে ভ্রু কুঁচকে ন্যাকামি ভঙ্গিতে বলল,
— “মা… দেখেন তো, কেমন খুঁত ধরা শুরু করেছে!”
নাজমা বেগম হাসি চেপে রাখলেন না।
— “খবরদার, আমার বৌমাকে নিয়ে একটাও কথা বলবি না! আমার বৌমা সেরা।”
রাতুল মুখে হাসি রেখে মায়ের দিকে তাকাল,
— “আচ্ছা আচ্ছা… এখন তো মনে হচ্ছে আমি একা হয়ে গেলাম এই সংসারে।”
সবার হাসির মধ্যে হঠাৎ বাইরের গেট থেকে ধাতব শব্দ শোনা গেল। তারপর ধীর পায়ের শব্দ, আর এক মুহূর্ত পরেই দরজার পাশে দাঁড়াল এক লম্বা, গাঢ় কালো মানুষ। তার মুখে অদ্ভুত গম্ভীরতা, চোখে গভীর দৃষ্টি। ধুলো লাগা নীল শার্ট, হাতের আঙুলে পুরনো সোনালি আংটি।
সবার দৃষ্টি একসঙ্গে তার দিকে ঘুরে গেল।
লতা থেমে গিয়ে দরজার দিকে তাকাল, তারপর হাসিমুখে বলল,
— “বড় মালিক, আপনি যে আনতে বলেছিলেন… এই হরিশ। আমাদের গ্রামের মানুষ।”
মো. আজিম চশমার ফাঁক দিয়ে মানুষটাকে মাথা থেকে পা পর্যন্ত লক্ষ্য করলেন।
— “হঁম… লম্বা তো বটে। ড্রাইভিং জানিস?”
হরিশ বিনম্র গলায় উত্তর দিল,
— “জানি, সাহেব। বিশ বছর গাড়ি চালাইছি।”
রিয়া চুপচাপ তার দিকে তাকিয়ে রইল, চোখে যেন একটু কৌতূহল। আর হরিশও, ভদ্রভাবে মাথা নিচু করলেও, এক মুহূর্তের জন্য তার কালো চোখ দুটো রিয়ার মুখে থেমে রইল।
ডাইনিং টেবিলে হঠাৎ যেন কিছুটা নীরবতা নেমে এলো—যেন নতুন কারও আগমনে ঘরের বাতাসেই বদল এসে গেছে।
পর্ব ২
সেদিন নাস্তার পরেই মি. আজিম বাইরে বেরোলেন হরিশকে নিয়ে। আঙিনায় দাঁড়িয়ে পুরনো সাদা মাইক্রোবাসটা দেখিয়ে বললেন—
— “চল, এক চক্কর দিয়ে আয় দেখি কেমন চালাস।”
হরিশ নীরবে দরজা খুলে ভেতরে বসল। লম্বা হাত দিয়ে স্টিয়ারিং ধরার ভঙ্গিতেই বোঝা যাচ্ছিল, সে গাড়ির সঙ্গে অপরিচিত নয়। ইঞ্জিন চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একধরনের মসৃণ শব্দ উঠল—যেন অনেক দিন ধরে সে এই গাড়িটাই চালিয়ে আসছে।
মি. আজিম সামনে বসে নির্দেশ দিচ্ছিলেন,
— “এখান দিয়ে ঘুর… হ্যাঁ, ব্রেকটা টিপে দেখ… ভালো, এবার রিভার্স কর।”
ড্রাইভিং টেস্ট শেষ হতেই আজিম কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন, তারপর গম্ভীর মুখে বললেন—
— “থাক, আর কাউকে খোঁজার দরকার হবে না।”
এরপর থেকে হরিশের সকাল শুরু হতো গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে গাড়ি মুছে, তেলের মাত্রা চেক করে, আর কখনো কখনো নাজমা বেগমকে বাজারে পৌঁছে দিয়ে। বিকেলে মি. আজিমের সঙ্গে ব্যবসার কাজে বের হতো, আবার সন্ধ্যায় রাতুলকে অফিস থেকে আনত।
রিয়া মাঝে মাঝে বারান্দা থেকে তাকিয়ে দেখত—গাড়ির দরজা খুলে দেওয়ার সময় হরিশ মাথা নত করে দাঁড়িয়ে থাকে, কথা কম বলে, কিন্তু কাজে ভুল করে না।
এক মাস এভাবেই কেটে গেল। ধীরে ধীরে হরিশ হয়ে উঠল পরিবারের একজন বিশ্বস্ত মানুষ।
নাজমা বেগম নিশ্চিন্ত মনে বলতেন—
— “হরিশ থাকলে গাড়ি নিয়ে আমার আর কোনো দুশ্চিন্তা নেই।”
লতাও খুশি—নিজ গ্রামের মানুষকে এনে কাজে লাগাতে পেরে যেন তার ভেতরে এক গোপন গর্ব। আর হরিশ… সব সময় দূরে দাঁড়িয়ে, চুপচাপ, কিন্তু পরিবারের প্রতিটি সদস্যের অভ্যাস, যাতায়াতের সময়—সব যেন ধীরে ধীরে মুখস্থ করে নিচ্ছে।
পর্ব ৩
সেদিন রাতটা অস্বাভাবিক নীরব ছিল। দেয়াল ঘড়ির কাঁটা তখন সাড়ে এগারো ছুঁইছুঁই, কিন্তু রাতুলের কোনো খোঁজ নেই। বিকেলে বের হওয়ার সময় বলেছিল— “আজ ফিরতে দেরি হবে, ঘুমিয়ে যেও।”
কিন্তু মোবাইলটা ভুলে রেখে গেছে টেবিলে—যার মানে যোগাযোগের কোনো উপায় নেই।
রিয়া সোফায় বসে টিভির পর্দায় ফাঁকা চোখে তাকিয়ে ছিল। মাথায় নানা চিন্তা ঘুরছিল—রাতুল ঠিক আছে তো? কোথায় গেল? গাড়ি নষ্ট হলো নাকি? বাইরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে, জানলার কাঁচে টুপটাপ শব্দ পড়ছে।
উপরে শ্বাশুড়ির রুম থেকে ভেসে আসছে নিয়মিত নাক ডাকার শব্দ—নাজমা বেগম একবার ঘুমিয়ে পড়লে সহজে জাগেন না। শ্বশুর তো ব্যবসার কাজে শহরের বাইরে।
ডুপ্লেক্স বাড়ির ভেতরে যেন এক অদ্ভুত ফাঁকা ভাব নেমে এসেছে। রিয়া উঠে দাঁড়াল। নিজের রুমের বারান্দা থেকে নিচে তাকিয়ে দেখল—গেটের বাইরে রাস্তাটা ফাঁকা, স্ট্রিটলাইটের আলোয় শুধু হালকা কুয়াশা ভাসছে।
কিছুক্ষণ দ্বিধা করে সে নিচের সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলো। নিচতলার একপাশে লতার ছোট্ট ঘর—দরজা বন্ধ, ভেতরে কোনো শব্দ নেই। অন্যপাশে, করিডরের শেষ মাথায় হরিশের ঘর। কাঠের পুরনো দরজাটা আধো আঁধারে দাঁড়িয়ে আছে, দরজার সামনে ছোট্ট বাল্ব জ্বলছে ম্লান আলোয়।
রিয়ার বুকের ভেতর কেমন এক ধরণের টান অনুভূত হচ্ছিল—চিন্তা, কৌতূহল আর একটুখানি দ্বিধা মিশ্রিত। সে হাত তুলে ধীরে ধীরে টোক টোক করে নক করল।
নীরবতা।
তারপর ভেতর থেকে ধীর কণ্ঠে গম্ভীর একটা শব্দ—
— “কেডারে?”
রিয়া হালকা গলায় বলল,
— “আমি… রিয়া। একটু দরজা খুলবেন?”
দরজার ভেতর থেকে তালার শব্দ, তারপর ধীরে ধীরে দরজা ফাঁক হলো। ম্লান আলোয় দাঁড়িয়ে থাকা হরিশের মুখে একরাশ ঘুমঘুম ভাব, কিন্তু চোখ দুটো অদ্ভুতভাবে সজাগ।
— “কী হয়েছেরে? রাতে কি হয়েছে, তোরা কি আমাকে কিনে নিয়েছিস?যখন ইচ্ছা তখন কাজ করব”
আসলে হরি ঘুমের মধ্যে কাওকে চিনে না, ঘুম কেও ডাক দিলে সে রেগে যায়।
রিয়া এক মুহূর্ত তার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকল, তারপর নিচু স্বরে বলল—
— “আপনি এভাবে কেন কথা বলছেন? রাতুল এখনো ফিরে নি, তাই আমি চিন্তা করছি।”
---”তোর স্বামী আমাকে বলেছে চলে আসতে, তার আজ বিদেশি পার্টির সাথে মিটিং।“
হরিশ রিয়ার সামনে গেইট বন্ধ করে দেয় জোরে। রিয়া খুব অপমানিত বোধ করে এবং রাগে সে ফায়ার হয়ে যায়।?