অধ্যায় ৩
মাঠাকুরায়ন তার দুই পায়ের তলা দিয়ে মাটিতে খেলেন আমার ঘন মখমলে লম্বা এলো চুল মাড়ালেন আর তারপরে আবার খাটে পা গুটিয়ে বসলেন।
আমি একই বিনীত অবস্থায় বললাম, “ছায়া মাসি, তুমিও আমার চুলে পা দাও, তবেই আমি মাথা তুলব”
“অ্যাই! আরে! পাগলী মেয়ে... তুই কি যে আবোল-তাবোল বলছিস? আমি আবার তোর চুলে পা দিতে যাব কেন? “, ছায়া মাসি দ্বিধায় পড়ে গেল।
আমি বললাম “ এতে ক্ষতিটা কি ছায়া মাসি তুমিওতো আমার গুরুজন, তুমি কি আমায় আশীর্বাদ করবে না?”
ছায়া মাসির গাঁটে গাঁটে ব্যথা থাকা সত্ত্বেও তিনি কোনো রকমে নিজের পা নামিয়ে মাটিতে খেলানো আমার চুলমাড়ালেন আর বেশ কষ্টের সঙ্গেই আবার নিজের পা দুটো ওপরে তুলে গুটিয়ে আগেকার মতন বসলেন। বৃষ্টির ভিজে আবহাওয়া তে উনার বাতের ব্যাথার জন্য একটু বেড়েছে| কবিরাজমশাই ঔষধপত্র কিছুই হচ্ছে না আশাকরি মাঠাকুরায়নের কোন পদ্ধতি যেন কার্যকরী হয়।
এইবারও আমি বিব্রত হয়ে উঠে বসলাম কিন্তু উঠে বসতে গিয়ে হঠাৎ করে আমার আঁচলটা ফস্কে গিয়ে মাটিতে পড়ে গেল আর আমার শুধু মাত্র কাটা খেঁটে ব্লাউজে ঢাকা স্তনজোড়া খাটে বসে থাকা আমার দুই গুরুজন মহিলার সামনে একেবারে যেন আদুড় হয়ে গেল।
ইস! এই কাটা খেতে ব্লাউজে আমার স্তনের বোঁটা গুলো একেবারে যেন ফুটে উঠেছে আর আমি জানি যে যে আমার এই অবস্থায় আমার মাঠাকুরায়নের চোখে ঠিকই পড়েছে।
আমি যত তাড়াতাড়ি পারি নিজের অনেক সামলে ঘাড়ের কাছে চুল জড়ো করে এবং একটি খোঁপা বেঁধে নিলাম হাজার হোক, আমি নিজের মাথায় আমার বড়দের পায়ের ধুলো নিয়েছিলাম, আমি কীভাবে আমার চুল এভাবে খোলা রেখে দিতে পারি?
তারপরে সামনে হাত নেড়ে মাথা নত করে আমি দাঁড়িয়ে রইলাম।
“আরি বাহ, ছায়া!”, মাঠাকুরায়ন বেশ খানিক্ষন ধরেই আমাকে লক্ষ করলছিলেন, আর উনি বললেন, “আজ অনেকদিন পর আমি একটি মেয়ের আধ-ভেজা চুলে পা রেখেছি, আমার ইটা বেশ ভাল লেগেছে... অনেক দিন পর .... এই মেয়েটি গ্রামের রীতিনীতি এবং শিষ্টাচার সম্পর্কে পুরোপুরি সচেতন বলে মনে হচ্ছে ... এর ভালো শিক্ষা দীক্ষা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে একেবারে গাইঁয়ার মাইয়াদের মত... আমি কখন থেকে আমি এমন একটি মেয়ে খুঁজছি জেক নাকি আমি নিজের রাখেল করে রাখব...এই ঝিল্লিটা (মেয়েটা) কে, রি ছায়া? আগে কোন দিন তো তুই এর কথা আমাকে চিঠিতে জানাস নি?তাই জানতে চাই আসলে এই ঝিল্লিটা কে? “
ছায়া একটু ভাবতে লাগলো। তার জীবনের কিছু পুরান কথা তার মনে পরে যাচ্ছে ... তিনি মাঠাকুরায়নের মুখ থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে ঘরের কোণে দেখতে লাগলেন, যেন তার অতীত জীবন থেকে স্মৃতির কয়েক পাতা পাল্টাতে আরম্ভ করেছে তারপর তিনি বললেন, “হ্যাঁ, মাঠাকুরায়ন, আপনি তো আমার ব্যাপারে সবকিছুই জানেন ... বিয়ের কিছুদিন পর আমার স্বামী মারা গেল ... তারপর কি? আমার শ্বশুরবাড়ির থেকে বের করে দিল, তখন আমার বয়স ছিল মাত্র আঠারো বছর। আমার বাপের বাড়ির গ্রামের লোকেরাও আমাকে বাড়িতে থাকতে দেয়নি, তারা ভাবত যে আমি আমার স্বামীকে বিয়ের পরেই খেয়েছি ... হয়তো আমি এই পৃথিবীতে এসেছি একটি অভিশাপ হিসাবে ... সেই সময়ে যদি আপনি যদি আমার সাহায্য না করতেন তাহলে বোধ হয় আমার দেখা দুর্গাপুরের বকশী বাবু সাথে আর হট না আর উনি আর ওনার স্ত্রী আশ্রয় দিতেন না.... আর আমি জানি না আজ আমি কোন অবস্থায় থাকতাম ... আপনি তো জানেন যে এটি তার বাড়ি ... তিনি আমাকে এখানে পরিচারিকা হিসেবে থাকতে দিয়েছেন ... “
এইসব কথা বলতে বলতে ছায়া মাসির চোখে জল ভরে এল। আমি আবার নিজের আঁচলটা ঠিক করলাম আর তার গুনা দিয়ে ছায়া মাসির চোখের জল মুছিয়ে আপনার পাশে বসে ওনার কাঁধে মাথা রেখে ওনার পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে উনাকে সান্তনা দিতে লাগলাম।
“আমি এই জিনিসগুলো জানি, ছায়া ...”, মাঠাকুরায়ন স্নেহভরে আমার মুখ ও চুলে হাত বুলিয়ে তিনি আবার জিজ্ঞাসা করলেন, “কিন্তু তুই আমাকে এখনও বললি না যে এই ঝিল্লিটা কে? তোর যদি কোন মেয়ে হতো তাহলে হয়তো আজ এর বয়সিই হতো “, তারপর আমি লক্ষ্য করলাম যে মাঠাকুরায়ন এর মুখে যেন একটি বাঁকা হাসি ফুটে উঠল| আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম যে এবারে বোধহয় মাঠাকুরায়ন ছায়া মাসির আর আমার বাবার অবৈধ সম্বন্ধের দিকে ইশারা করে হয়তো এইটা জানতে চাইছেন যে আমি ওনাদের অবৈধ সন্তান কিনা|
আমি এই জিনিসটা কোনরকম খারাপভাবে নিলাম না, কারণ আমি এর আগেও এরকম কথা শুনেছি। মানুষ মনে করত ছায়া মাসি আমার বাবার উপপত্নী। এখন আমি বাস্তবতা জানি না, কিন্তু আমি এই সম্পর্কে এত শুনেছি যে এখন এই জিনিসগুলি আমার উপর আর কোন প্রভাব ফ্যালে না।
ছায়া মাসি এখনও কিছু বলেননি, তিনি শুধু কাঁদছিলেন ... কিন্তু মাঠাকুরায়ন এই বিষয়ে অনড় ছিলেন এবং বলেছিলেন, “কিন্তু এই ঝিল্লীটা কিন্তু এই ঝিল্লিটা তো তোর জন্ম দেয়া বলে মনে হচ্ছে না| তোর তুলনায় একে দেখতে ভারী সুন্দর দেখে মনে হয় বেশ ভাল জাতের ঝিল্লি... পাশের বাড়ির মেয়ে নাকি? একে কি তুই কোন গাছ থেকে পেড়ে আনলি না মেলা থেকে চুরি করে এনেছিস... কারণ আমি যতদূর আন্দাজ করছি, তোর যা সম্পত্তি আছে, তুই সবকিছু বিক্রি করেও এমন কোন ঝিল্লি কিনতে পারবি না... এমন একটা সুন্দরী পরিকে তুই কথার থেকে নিয়ে এলি? ... আ-হা-হা-হা”, এই বলে মাঠাকুরায়ন অট্ট হাঁসিতে ফেটে পড়লেন।
এটা শুনে আমি একটু অবাক হয়ে গেলাম, মাঠাকুরায়ন এসব কি বলছেন? কিন্তু তখন আমি ভাবলাম যে মায়াঠাকুরিন হয়তো ঠাট্টা করছিলেন, ছায়া মাসির মেজাজ ঠিক করার জন্য, কিন্তু তিনি তো আমার প্রশংসাই করছিলেন… এবং সর্বোপরি, মাঠাকুরায়নের মতো বিখ্যাত ও সম্মানিত মহিলার মুখ দিয়ে প্রশংসা শোনা কোন মেয়ের ভাল লাগবে না? আমি উল্টে খুশি হলাম।
মাঠাকুরায়ন লক্ষ্য করেছেন যে আমার নিজের প্রশংসা শুনে আমি লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছি ...
এবারে দেখলাম যে ছায়া মাসির মুখে যেন একটু হাসি ফুটল, “হা-হা-হা ... না, এই ঝিল্লিটা বকশি বাবুর মেয়ে। বকশী বাবু ব্যবসার খাতিরে গ্রাম থেকে দূরে একটি শহরে থাকতেন, এখানে এই গ্রামের এই তিন ঘরের দুই তলা বাড়িতে আমি বকশী বাবুর বিধবা মা এবং তার স্ত্রীর সাথে বসবাস করছিলাম ... “ তখন তিনি আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “এই ঝিল্লিটার ভাগ্যও আমার মতো দুর্ভাগ্যজনক, মাঠাকুরায়ন। বকশি বাবুর মাকে একদিন পরলোক গমন করতে হল... তার পরে এই ঝিল্লির মা - বেচারি জানতো না যে কোন রোগ আছে, মনে হয় রক্তের ক্যান্সার - সেও মারা গেল ... স্ত্রী মারা যাওয়ার পর বুকসী বাবু যেন কেমন যেন একটা হয়ে গিয়েছিলেন|
তাই এই ছেলেটাকে উনি আমার দেখাশোনা রেখে পুরোপুরি নিজের মনটা ব্যবসায় লাগিয়ে দিলেন| তবে হ্যাঁ উনি মাসে মাসে ঠিক আমাদের খবর নেন আর সংসার চালানোর জন্য যথেষ্ট টাকা পয়সা পাঠিয়ে দেন আর মাঝে মাঝে এসে আমাদের সাথে দেখা করে যান... তাই ছোটবেলা থেকেই আমি এই ঝিল্লিটাকে - বলতে পারেন একেবারে নিজের মেয়ের মতন করেই মানুষ করেছি...”
আমি আবার লক্ষ্য করলাম যে, মাঠাকুরায়ন যেন এক অজানা অভিপ্রায় নিয়ে আমাকে চোখে চোখে জরিপ করে যাচ্ছেন, আর আমার কেন জানি না মনে হচ্ছিল যে এইবারে উনার দৃষ্টি যেন আমার সারা শরীর অদ্ভুত ভাবে স্পর্শ করছে।
তিনি মুচকি হেসে বললেন, “আমি এক দেখাই বুঝে গিয়েছিলাম যে এই ঝিল্লিটা বেশ ভালো জাতের... যদিওবা তুই এর শিক্ষাদীক্ষা একটা গাইঁয়ার মাইয়ার মত করেছিস... কিন্তু এই বেশ ভাল জাতের ঝিল্লি”
“হ্যাঁ মাঠাকুরায়ন আপনি ঠিকই বলেছেন কিন্তু আমি এখন আর কি করি বলুন আমার এই বাতের ব্যথার জন্য আমি যে একদম নড়াচড়া কিছুই করতে পারছি না| আর সেই কারণে আমারি ঝিল্লি একটা দাসী-বাঁদির মত খালি খেটে যাচ্ছে... সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত| ঘর ঝাঁট দেওয়া, রান্না করা, বাসন মাজা, কাপড় কাচা সব কাজই তো এ করে যাচ্ছে”
এবারে আমি আবার লক্ষ্য করলাম যে মাঠাকুরায়ন কেমন যেন একটা দৃষ্টি নিয়ে আমাকে এক ভাবে দেখে যাচ্ছিলেন| উনার চাওনিতে এমন একটা কিছু ছিল যাতে আমি একটু অস্বস্তি বোধ করছিলাম তাই আমি একটু সংযত এবং সচেতন বোধ করে আঁচলটাকে আবার থেকে ঠিক করলাম আর নিজের চোখ নামিয়ে নিলাম...
এমন সময় মাঠাকুরায়ন আবার থেকে বললেন, “কটু কাছে আয় তো রি ঝিল্লি...”
ক্রমশ: