সকালের রোদ ঠিক যেন মেঘের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে বসন্তের স্পর্শ, গাছের পাতাগুলোতে রোদের কিরণ খেলা করছে। ইশান ক্লাসে বসে, তার হাতে একটি খোলা বই, আর চোখ যেন পাতায় আটকে নেই—দূরে তাকিয়ে আছে। তার নির্লিপ্ত চোখে কেউ সহজেই হারিয়ে যেতে পারে।
নন্দিনী দূর থেকে তাকিয়ে থাকে। ইশান যেন সবার থেকে আলাদা। বন্ধুবান্ধবের আড্ডায় নেই, মজা করা তো দূরে থাক—সে যেন নিজের মধ্যে গুটিয়ে থাকা এক মানুষ।
ক্লাস শুরু হয়, কিন্তু নন্দিনীর মন যেন অন্য কোথাও। ইশানের প্রতিটি নড়াচড়া তার চোখ এড়িয়ে যায় না। ক্লাস শেষে নন্দিনী সাহস করে ইশানের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়।
“তুমি কি আমাদের গ্রুপের সঙ্গে ক্যান্টিনে যাচ্ছ?”
ইশান একটু চমকে তাকায়।
“আমি? না... আমি একটু কাজ আছে। তুমি যাও।”
নন্দিনী তার চুপচাপ উত্তর শুনে থেমে যায় না।
“তুমি সবসময় একা থাকো কেন? একা একা থাকতে কি ভালো লাগে?”
ইশান মৃদু হেসে উত্তর দেয়,
“সবাই একা একা থাকার অর্থ বোঝে না। আমি একা থাকতে পছন্দ করি।”
নন্দিনী অবাক হয়। তার মতো মিশুক একজন মানুষ এরকম উত্তর সহজে মেনে নিতে পারে না। তবু সে ইশানের সঙ্গে সময় কাটানোর জন্য নতুন উপায় খুঁজতে থাকে।
দিন কয়েকের মধ্যে, নন্দিনী আরও সাহসী হয়ে ওঠে। ক্লাসের পর ইশানের কাছে গিয়ে বলে,
“চলো, আজ একটা কফি খাই। আমি দাওয়াত দিচ্ছি।”
ইশান প্রথমে একটু দ্বিধায় পড়ে। তারপর, কিছু না ভেবে বলে,
“ঠিক আছে। কিন্তু বেশি সময় নেই।”
কফি শপে গিয়ে নন্দিনী ইশানের অল্প কথা বলা স্বভাব নিয়ে মজা করতে শুরু করে।
“তুমি জানো, আমি যদি তোমার মতো চুপ থাকতাম, তাহলে কেউ আমাকে এক মিনিটেও সহ্য করতে পারত না!”
ইশান তার চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলে,
“তুমি যেমন আছো, সেটা অনেক ভালো। সবাইকে চুপ থাকতে হবে এমন কোনো কথা নেই।”
নন্দিনী আবার হেসে ফেলে। এই হাসি যেন ইশানের শান্ত জীবনে এক ধরনের আলো নিয়ে আসে।
ইশান আর নন্দিনী কফি শপে বসে। ইশান ধীরে ধীরে তার চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে, আর নন্দিনী তার সামনে বসে কথা বলছে। যদিও বেশিরভাগ সময় কথাগুলো একতরফা।
নন্দিনী হঠাৎই মুচকি হেসে বলে,
“তুমি জানো, আমি তোমার একটা নাম দিয়েছি?”
ইশান তার কফি কাপ নামিয়ে বলে,
“নাম? আমার নামে কি সমস্যা ছিল?”
“না, না, তোমার আসল নাম নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। তবে তোমার স্বভাবের জন্য এই নামটা বেশি মানায়,” বলে নন্দিনী তার ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে রাখে।
ইশান এক ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“কী নাম?”
নন্দিনী চোখ বড় বড় করে বলে,
“মিস্টার সাইলেন্ট।”
ইশান প্রথমে বিস্মিত হয়, তারপর একটু হেসে ফেলে। নন্দিনীর হাসির উচ্ছ্বাস যেন কফি শপের পুরো পরিবেশটাই বদলে দেয়।
“তুমি খুবই অদ্ভুত, জানো? সবাই এত কথা বলে, আর তুমি যেন একদম উল্টো। তাই তোমার জন্য এই নাম।”
ইশান একটু হেসে বলে,
“তাহলে আমি তোমাকে ‘মিস চ্যাটারবক্স’ বলতে পারি।”
নন্দিনী হেসে বলে,
“একদম ঠিক বলেছ। কিন্তু একটা কথা আছে, তুমি যদি এত চুপচাপ থাকো, তাহলে তোমার সঙ্গে বন্ধুত্ব করাটা আরও চ্যালেঞ্জিং হবে।”
“তুমি যদি সেটা উপভোগ করো, তবে আমার কোনো আপত্তি নেই,” ইশান মৃদু হেসে উত্তর দেয়।
এভাবেই সময় গড়াতে থাকে। নন্দিনী আর ইশানের মধ্যে এক অদ্ভুত সম্পর্ক তৈরি হয়। নন্দিনী যেমন ইশানকে তার নীরবতা থেকে বের করে আনতে চায়, তেমনি ইশান নন্দিনীর চাঞ্চল্যপূর্ণ জীবনযাপনকে প্রশান্তির সঙ্গে গ্রহণ করে।
একদিন ক্লাসের পরে, নন্দিনী আবার ইশানের কাছে এসে বলে,
“তুমি কি জানো, সবাই বলে তুমি আমার জন্যই একটু একটু করে বদলাচ্ছ?”
ইশান তার বই বন্ধ করে বলে,
“আমার বদলানোর কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। তবে তোমার সঙ্গে সময় কাটানো মন্দ নয়।”
নন্দিনী খুশি হয়ে বলে,
“এটাই তো সবচেয়ে বড় কথা! মিস্টার সাইলেন্ট যদি একটু একটু কথা বলা শুরু করে, তবে সেটাই আমার বিজয়।”
ইশান তার শান্ত চোখে নন্দিনীর দিকে তাকায়। নন্দিনীর মিষ্টি হাসি আর চঞ্চলতা যেন তার নির্লিপ্ত জীবনে রঙ এনে দিচ্ছে। কিন্তু তার মনের গভীরে কোথাও যেন একটা অদ্ভুত শূন্যতা থেকে যায়, যার কথা সে নন্দিনীকে কখনো বলে না।
এক সন্ধ্যার কথা। ক্লাসের পরে পুরো ক্যাম্পাসটা যেন একটু বেশিই নির্জন। নন্দিনী ইশানের পাশে দাঁড়িয়ে বলে,
“আজ একটু হাঁটতে বের হবে? ক্যান্টিনে বসে থাকাটা বিরক্তিকর হয়ে গেছে।”
ইশান প্রথমে একটু থমকে যায়।
“এই সময়ে?”
“হ্যাঁ! সন্ধ্যার বাতাসে হাঁটলে মাথাটা অনেক হালকা লাগে। তুমি তো এমনিতেই চুপচাপ মানুষ, তোমার তো এটা বেশ উপভোগ করার কথা!”
ইশান একটু মুচকি হেসে বলে,
“তোমার সঙ্গে বেশি সময় কাটানোর মানে হলো আরও বেশি কথা শুনতে হবে।”
“ঠিক ধরেছ,” নন্দিনী হেসে ওঠে।
তারা ক্যাম্পাসের বাগানে হাঁটতে শুরু করে। নন্দিনী মাটির দিকে তাকিয়ে শুকনো পাতা নিয়ে খেলতে খেলতে বলে,
“ইশান, তুমি কখনো কারও খুব কাছের হওনি, তাই না?”
ইশান প্রশ্নটা শুনে থেমে যায়। তার চোখের কোণায় যেন এক ধরনের অস্বস্তি।
“আমার জীবনে এরকম কেউ ছিল না, যাকে আমি খুব কাছের মনে করেছি। হয়তো আমি এটাই ঠিক মনে করি।”
নন্দিনী থেমে বলে,
“তাহলে কি তোমার কাছে বন্ধুত্বের কোনো মূল্য নেই?”
ইশান সরাসরি চোখে তাকিয়ে বলে,
“মূল্য আছে। কিন্তু আমি আমার পৃথিবীটা সবসময় ছোট রাখতে চাই। তুমি যদি সেটা মেনে নিতে পারো, তাহলে আমাদের বন্ধুত্ব টিকে থাকবে।”
নন্দিনী গভীরভাবে তার কথা শোনে। সে জানে, ইশানের ভেতরে একটা গভীর রহস্য লুকিয়ে আছে, যা তার একাকিত্বকে জন্ম দিয়েছে।
পরবর্তী কয়েক সপ্তাহে নন্দিনী ধীরে ধীরে ইশানের মন জয় করার জন্য নানা কিছু করে। কখনো ক্যান্টিনে খাবার অর্ডার করে তার টেবিলে রেখে দেয়, কখনো ক্লাসের নোটগুলো ইশানের জন্য সুন্দর করে লিখে দেয়।
একদিন, ইশান যখন লাইব্রেরিতে বসে, নন্দিনী হঠাৎ হাজির হয়ে বলে,
“আজ আর পড়াশোনা নয়। চলো, একটা জায়গায় নিয়ে যাচ্ছি।”
“কোথায়?” ইশান কিছুটা অবাক হয়।
“সারপ্রাইজ! চলো।”
নন্দিনী ইশানকে ক্যাম্পাসের পাশের একটা নির্জন পার্কে নিয়ে যায়। পার্কের মাঝখানে একটা পুরোনো বেঞ্চে বসে, সে বলে,
“তুমি জানো, এখানে বসে আমি কতবার ভেবেছি, তোমার মতো নির্লিপ্ত মানুষকে কীভাবে একটু খুশি করা যায়?”
ইশান একটু হাসে।
“তুমি তাহলে আমার মন খুশি করার প্রকল্পে আছো?”
“অবশ্যই!” নন্দিনী হেসে বলে। “তুমি আমার ‘মিস্টার সাইলেন্ট’, আর তোমার হাসি আমার বিজয়।”
তাদের এই নির্জন সময়ে ইশানের মুখে এক ঝলক শান্তি দেখা দেয়। নন্দিনীর এই প্রাণবন্ত উপস্থিতি তার নির্জন জগতে যেন একটু একটু করে আলো ঢুকিয়ে দিচ্ছে।
দ্বিতীয় অধ্যায়: সম্পর্কের দোলাচল
এক সন্ধ্যার কথা। ক্লাসের পরে পুরো ক্যাম্পাসটা যেন একটু বেশিই নির্জন। নন্দিনী ইশানের পাশে দাঁড়িয়ে বলে,
“আজ একটু হাঁটতে বের হবে? ক্যান্টিনে বসে থাকাটা বিরক্তিকর হয়ে গেছে।”
ইশান প্রথমে একটু থমকে যায়।
“এই সময়ে?”
“হ্যাঁ! সন্ধ্যার বাতাসে হাঁটলে মাথাটা অনেক হালকা লাগে। তুমি তো এমনিতেই চুপচাপ মানুষ, তোমার তো এটা বেশ উপভোগ করার কথা!”
ইশান একটু মুচকি হেসে বলে,
“তোমার সঙ্গে বেশি সময় কাটানোর মানে হলো আরও বেশি কথা শুনতে হবে।”
“ঠিক ধরেছ,” নন্দিনী হেসে ওঠে।
তারা ক্যাম্পাসের বাগানে হাঁটতে শুরু করে। নন্দিনী মাটির দিকে তাকিয়ে শুকনো পাতা নিয়ে খেলতে খেলতে বলে,
“ইশান, তুমি কখনো কারও খুব কাছের হওনি, তাই না?”
ইশান প্রশ্নটা শুনে থেমে যায়। তার চোখের কোণায় যেন এক ধরনের অস্বস্তি।
“আমার জীবনে এরকম কেউ ছিল না, যাকে আমি খুব কাছের মনে করেছি। হয়তো আমি এটাই ঠিক মনে করি।”
নন্দিনী থেমে বলে,
“তাহলে কি তোমার কাছে বন্ধুত্বের কোনো মূল্য নেই?”
ইশান সরাসরি চোখে তাকিয়ে বলে,
“মূল্য আছে। কিন্তু আমি আমার পৃথিবীটা সবসময় ছোট রাখতে চাই। তুমি যদি সেটা মেনে নিতে পারো, তাহলে আমাদের বন্ধুত্ব টিকে থাকবে।”
নন্দিনী গভীরভাবে তার কথা শোনে। সে জানে, ইশানের ভেতরে একটা গভীর রহস্য লুকিয়ে আছে, যা তার একাকিত্বকে জন্ম দিয়েছে।
পরবর্তী কয়েক সপ্তাহে নন্দিনী ধীরে ধীরে ইশানের মন জয় করার জন্য নানা কিছু করে। কখনো ক্যান্টিনে খাবার অর্ডার করে তার টেবিলে রেখে দেয়, কখনো ক্লাসের নোটগুলো ইশানের জন্য সুন্দর করে লিখে দেয়।
একদিন, ইশান যখন লাইব্রেরিতে বসে, নন্দিনী হঠাৎ হাজির হয়ে বলে,
“আজ আর পড়াশোনা নয়। চলো, একটা জায়গায় নিয়ে যাচ্ছি।”
“কোথায়?” ইশান কিছুটা অবাক হয়।
“সারপ্রাইজ! চলো।”
নন্দিনী ইশানকে ক্যাম্পাসের পাশের একটা নির্জন পার্কে নিয়ে যায়। পার্কের মাঝখানে একটা পুরোনো বেঞ্চে বসে, সে বলে,
“তুমি জানো, এখানে বসে আমি কতবার ভেবেছি, তোমার মতো নির্লিপ্ত মানুষকে কীভাবে একটু খুশি করা যায়?”
ইশান একটু হাসে।
“তুমি তাহলে আমার মন খুশি করার প্রকল্পে আছো?”
“অবশ্যই!” নন্দিনী হেসে বলে। “তুমি আমার ‘মিস্টার সাইলেন্ট’, আর তোমার হাসি আমার বিজয়।”
তাদের এই নির্জন সময়ে ইশানের মুখে এক ঝলক শান্তি দেখা দেয়। নন্দিনীর এই প্রাণবন্ত উপস্থিতি তার নির্জন জগতে যেন একটু একটু করে আলো ঢুকিয়ে দিচ্ছে।
তৃতীয় অধ্যায়: ইশানের মনস্তত্ত্বের জটিলতা
শীতের সকালের কথা। ক্যাম্পাসের গেট দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে নন্দিনী দেখতে পায়, ইশান লাইব্রেরির সামনে বসে বই পড়ছে। তার চোখে এক ধরনের গভীরতা। নন্দিনী কাছে গিয়ে বলে,
“তুমি কি জানো, তুমি সবসময় এইভাবে বই পড়লে কেউ তোমাকে বোরিং ভাবতে পারে?”
ইশান বই থেকে চোখ তুলে তাকায়।
“তুমি তো আমাকে ইতিমধ্যে ‘মিস্টার সাইলেন্ট’ বলেছ, বোরিং বলা আরও একটা নাম হবে। তাতে সমস্যা নেই।”
নন্দিনী হাসতে হাসতে বলে,
“না, এটা মেনে নেওয়া যাবে না। তুমি আমার জন্য একটু আলাদা। আর আলাদা মানুষদের ‘বোরিং’ বলা ঠিক না।”
ইশান কিছু বলে না। নন্দিনী তার পাশে বসে। চারদিকে শীতের হালকা কুয়াশা। নন্দিনী চুপচাপ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে, তারপর বলে,
“ইশান, আমি জানি তোমার ভেতরে অনেক কিছু লুকানো আছে। কিন্তু তুমি জানো, আমি লুকানো জিনিস বের করার খেলায় খুব ভালো।”
ইশান মৃদু হেসে বলে,
“তোমার এই খেলার ফলাফল কী হবে, সেটা তুমি জানো না।”
“তাহলে দেখাই যাক, আমার এই খেলা কতটা মজার হতে পারে,” বলে নন্দিনী সেদিন থেকে ইশানের মনের জটিল আবেগগুলোর সন্ধান করা শুরু করে।
রাত গভীর। জানালার বাইরে শীতল হাওয়ার শব্দ কানে ভেসে আসে। ইশান বিছানায় শুয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার চোখে ঘুম নেই। নন্দিনীর কথা মনের গভীরে বারবার প্রতিধ্বনিত হয়।
“নন্দিনী... এত প্রাণবন্ত কেন ও? আমার মতো একজন নির্লিপ্ত আর নীরব মানুষের সঙ্গে কেন এতটা আন্তরিক হতে চায়?” ইশান দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
তার মনে পড়ে, কীভাবে নন্দিনী তাকে ‘মিস্টার সাইলেন্ট’ বলে ক্ষেপাতো। সেই মিষ্টি হাসি, যা কোনো কঠিন মনকেও নরম করে দিতে পারে। “আমার মতো একজন মানুষ, যে সবসময় নিজের ভেতরেই ডুবে থাকে, তার পাশে থাকার মতো শক্তি ওর কোথা থেকে আসে?”
ইশান গভীরভাবে ভাবে, “আমি জানি, ও আমাকে বদলানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু কেন? ও কি জানে, আমি বদলাতে চাই না? নাকি আমি নিজেই বুঝি না যে ওর সঙ্গ আমার জন্য কতটা জরুরি হয়ে উঠেছে?”
তার ভেতরে দ্বন্দ্ব কাজ করে। নন্দিনীর প্রতি যে অদ্ভুত এক টান অনুভব করছে, সেটি কি বন্ধুত্বের বাইরে কিছু? সে নিজেকে প্রশ্ন করে। “এই অনুভূতিগুলো যদি বন্ধুত্বের বাইরে হয়, তবে আমি কি সেটা মেনে নিতে পারি? আমি কি নন্দিনীকে এভাবে ভাবার অধিকার রাখি?”
ইশান জানালার দিকে তাকায়। চাঁদের আলো ঘরের ভেতর ঢুকে এক ধরণের প্রশান্তি ছড়িয়ে দিচ্ছে। কিন্তু তার মন অস্থির। “নন্দিনী আমার জীবনের একঘেয়েমি ভেঙেছে। আমার মনে এক অন্যরকম রঙ এনেছে। ও ছাড়া আমি কি আবার সেই পুরোনো নিঃসঙ্গতায় ফিরে যাব?”
ইশান এক গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তার চোখে ঘুম আসে না। মনের ভেতর নন্দিনীর হাসিমুখ আর চঞ্চল কথাগুলো ঘুরপাক খেতে থাকে।
বন্ধুত্ব থেকে আরও এক ধাপ
ইশান তার জীবন নিয়ে সবসময় নির্লিপ্ত ছিল। কিন্তু নন্দিনীর সঙ্গে কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত যেন তার ভেতরের সত্তাকে নাড়া দিতে থাকে। নন্দিনীর প্রাণবন্ত হাসি, অকপট কথা, আর ইশানকে বদলানোর অবিরাম চেষ্টা ইশানের ভেতরে অদ্ভুত এক অনুভূতি তৈরি করে।
একদিন ক্যাম্পাসের বেঞ্চে বসে নন্দিনী বলে,
“তুমি জানো, ইশান, আমি তোমার সাইলেন্ট জগৎটা ভেঙে ফেলতে চাই। আমি চাই তুমি আর এই নীরবতায় বন্দি থাকবে না।”
ইশান কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর বলে,
“তুমি কি জানো, নীরবতার মধ্যেও অনেক কথা লুকিয়ে থাকে? আমার কথা না বলার মানে এই নয় যে আমি অনুভব করি না।”
নন্দিনী গভীরভাবে তার চোখে তাকায়।
“তাহলে আমাকে সেগুলো শোনাও। আমি শুনতে চাই।”
ইশান কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়। তার মনের গভীরে যে অনুভূতির ঝড় চলছে, সেটি নন্দিনীকে বলতে সে এখনও প্রস্তুত নয়।
ইশান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তার চোখ নদীর পানির দিকে, যেন সে নিজের কথাগুলো জলে ফেলে দিতে চায়।
“তুমি জানো, আমার জীবনে খুব কম মানুষই ছিল, যাদের আমি সত্যিই বিশ্বাস করেছি। আর তাদের অনেকেই আমাকে ভুল বুঝেছে। তাই আমি চুপ থাকতে শিখেছি।”
নন্দিনী তার কথাগুলো গভীর মনোযোগে শোনে।
“তুমি চুপ থাকলেও আমি জানি, তোমার ভেতরে অনেক আবেগ লুকিয়ে আছে। কিন্তু তুমি আমাকে সেটা বলার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছো না।”
ইশান মৃদু হাসে। “তুমি হয়তো ঠিকই বলেছ। তবে তুমি যদি সত্যিই আমার পাশে থাকতে পারো, তাহলে হয়তো একদিন সব কথা বলব।”
চতুর্থ অধ্যায়: বন্ধুত্বের গভীরতা এবং লুকানো সত্যের প্রথম আভাস
নন্দিনী ইশানের মনের গভীরে ঢোকার চেষ্টা করলেও ইশান এখনো পুরোপুরি নিজের কথা বলতে প্রস্তুত নয়। তবে ধীরে ধীরে নন্দিনীর সঙ্গে তার বন্ধুত্ব গভীর হয়ে উঠছে।
একদিন বিকেলে ক্যাম্পাসের খোলা প্রাঙ্গণে তারা বসে। সূর্যের আলো নরম হয়ে এসেছে। নন্দিনী চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলে,
“ইশান, তুমি কি কখনো কারও প্রতি এমন কিছু অনুভব করেছ, যেটা কাউকে বলা যায় না?”
ইশান কিছুক্ষণ চুপ থাকে। তারপর বলে,
“হয়তো করেছি। তবে সেটা কাউকে বলার মতো সাহস পাইনি।”
নন্দিনী হেসে বলে,
“তুমি বলবে না, সেটা জানি। কিন্তু আমি ঠিক বের করব।”
ইশান তার দিকে তাকায়। নন্দিনীর চোখে গভীর প্রত্যয়ের ছাপ।
“তুমি যদি জানো, সেটা হয়তো তোমার ধারণার বাইরে যাবে,” ইশান মৃদু গলায় বলে।
“অতটা নিশ্চিত হবে না,” বলে নন্দিনী তার পাশে আরো কাছে সরে আসে।
ইশানের একাকী রাত এবং মাধুরীর প্রতি অনুভূতি
সেদিন রাতে ইশান আবার শুয়ে থাকে। তার মনের মধ্যে সেই চিরচেনা মুখটা ভেসে ওঠে—মাধুরী।
“তোমাকে কি বলার কোনো উপায় আছে, মাধুরী? তুমি তো জানোই না, আমার এই ছোট্ট জীবনের সবচেয়ে বড় জায়গাটা তোমার দখলে। কিন্তু আমি কীভাবে বলব?”
ইশানের চোখে জল এসে পড়ে। সে ভাবতে থাকে, “তুমি আমাকে এত বছর ধরে আগলে রেখেছ, নিজের মতো করে ভালোবেসেছ। কিন্তু আমি তোমার সেই স্নেহময় ভালোবাসার বাইরে গিয়ে কিছু অনুভব করেছি। এটা কি ঠিক?”
তার মনে দ্বন্দ্বের ঝড় ওঠে।
“সমাজ আমাদের মেনে নেবে না। তুমি আমাকে কখনোই সেভাবে দেখনি। কিন্তু আমি কেন প্রতিদিন তোমার কথা ভাবি, কেন তোমার মুখটাকে সব সময় নিজের মনের মধ্যে আঁকা দেখি?”
নন্দিনীর মাধুরী সম্পর্কে প্রথম ধারণা
পরের দিন সকালে নন্দিনী যখন ইশানের পাশে বসে, তখন ইশানের মুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট।
“রাতে ঘুমাওনি?” নন্দিনী জিজ্ঞেস করে।
“কিছু ভাবছিলাম,” ইশান ছোট করে উত্তর দেয়।
নন্দিনী তাকে ক্ষুধি দিয়ে দেখে। “তোমার মনে একটা বোঝা কাজ করছে, সেটা আমি টের পাচ্ছি। তবে তুমি কি জানো, আমি সেটা ভাঙার জন্য এখানে আছি?”
ইশান কিছু বলে না।
“তোমার জীবনে কি এমন কেউ আছে, যাকে তুমি চাইলেও বলতে পার না?” নন্দিনী সরাসরি প্রশ্ন করে।
ইশান কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,
“হয়তো আছে। তবে সেটা বলার মতো সময় এখনো আসেনি।”
নন্দিনী হাল ছাড়ার মেয়ে নয়।
“ঠিক আছে, আমি অপেক্ষা করব। তবে একটা কথা মনে রেখো—আমি তোমার সাইলেন্ট জগৎটাকে ভেঙে দেব, যেভাবেই হোক।”
পঞ্চম অধ্যায়: মাধুরীর ছায়া এবং নন্দিনীর কৌতূহল
ইশানের জীবন যেন ক্রমেই আরও জটিল হয়ে উঠছে। মনের গভীরে লুকানো অনুভূতি, নন্দিনীর অপরিসীম কৌতূহল, আর নিজের দ্বিধাগ্রস্ত অবস্থার মধ্যে সে আটকে আছে।
সেদিন নন্দিনী ইশানের পাশে বসে একটি খোলা জায়গায় আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে,
“ইশান, আমি তোমার মতো একটা বিষয় বোঝার চেষ্টা করছি। তুমি এমন কেউ, যে খুব কম কথা বলে, কিন্তু গভীরভাবে অনুভব করে। তোমার ভেতরে অনেক কিছু লুকানো আছে, তাই না?”
ইশান একটু হেসে বলে,
“তুমি কিভাবে এমনটা বুঝলে?”
“কারণ, আমি তোমার চোখে দেখেছি। তোমার চোখ অনেক কথা বলে, যদিও তুমি তা মুখে বলো না।”
ইশান তার কথায় কোনো জবাব দেয় না। সে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।
নন্দিনীর পরিকল্পনা
পরের দিন ক্লাস শেষে নন্দিনী ইশানকে বলে,
“তুমি সবসময় এমন চুপচাপ কেন থাকো? তোমাকে একটু চমকে দেওয়ার জন্য কিছু একটা করতেই হবে।”
“আবার কোনো নতুন প্ল্যান?” ইশান জিজ্ঞেস করে।
“নিশ্চয়ই। আগামী শুক্রবার বিকেলে তুমি আমার সঙ্গে থাকবে। আমি তোমাকে একটা বিশেষ জায়গায় নিয়ে যাব।”
“কোথায়?”
“এটা এখনই বলব না। তবে একটা কথা বলে রাখি—সেটা এমন এক জায়গা, যেখানে তুমি কখনো ছিলে না। আর আমি নিশ্চিত, সেটা তোমার মনকে বদলে দেবে।”
মাধুরীর স্মৃতিতে ইশানের রাত
রাতে ইশান যখন নিজের ঘরে শুয়ে থাকে, তখন তার মনের মধ্যে মাধুরীর স্মৃতিগুলো ভেসে ওঠে। মাধুরীর সেই মমতাময়ী হাসি, তার চোখের গভীর মায়া—সব যেন ইশানের মনের ভেতর অগোছালো ঝড় তুলে দেয়।
“তুমি জানো না, মাধুরী, তোমার প্রতি আমার এই অনুভূতিগুলো কিভাবে লুকিয়ে রাখি। তোমাকে আমি কখনো বলতে পারব না। কারণ, তুমি আমাকে যে স্নেহ কর, সেটা আমি ভাঙতে চাই না। ইশান এক অজানা অপরাধবোধে ভোগে।
ইশান তার চিন্তা থামাতে চায়, কিন্তু পারে না।
পরবর্তী দিনের পরিকল্পনা
শুক্রবার বিকেলে নন্দিনী ইশানকে শহরের বাইরে একটা জায়গায় নিয়ে যায়। জায়গাটা নির্জন, তবে অসম্ভব সুন্দর। সেখানে বসে নন্দিনী ইশানকে বলে,
“তুমি যদি এখানকার পরিবেশে একটু মন খুলে বলতে পার, আমি তোমার পাশে থাকব।”
ইশান কিছুক্ষণ চুপ থাকে। তারপর বলে,
“তুমি কি কখনো এমন কাউকে ভালোবেসেছ, যাকে ভালোবাসাটা প্রকাশ করাই অসম্ভব?”
নন্দিনী চমকে যায়। “তুমি কি বলতে চাও, তোমার জীবনে এমন কেউ আছে?”
ইশান সরাসরি কিছু বলে না। তবে তার চোখে মাধুরীর মুখচ্ছবির ছায়া স্পষ্ট।
ইশান এক মুহূর্ত থেমে নন্দিনীর চোখে তাকায়।
“তুমি এটা জানতে চাও কেন?”
“কারণ, আমি তোমার বন্ধু। আর বন্ধুর জীবনের এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমি জানব না, এটা হতে পারে না।”
ইশানের প্রতিরোধ এবং নন্দিনীর জেদ
ইশান একটু বিরক্ত সুরে বলে,
“সব কথা জানার প্রয়োজন নেই, নন্দিনী। কিছু কথা বলার জন্য সময় দরকার হয়।”
“সময়! আর কত সময় লাগবে? ইশান, তুমি জানো, আমি এত সহজে হাল ছাড়ি না। আমি জানবই।”
ইশান মৃদু হেসে বলে,
“তুমি সত্যিই আমার জীবন সহজ করে দাও না।”
“তোমার জীবন সহজ করার দায়িত্ব আমার। তাই আমাকে বলো, সেই মানুষটি কে?”
ইশান গভীরভাবে শ্বাস নেয়।
“তুমি যদি জানো, তবে হয়তো আমাকে আর দেখতে চাও না। কারণ, সে এমন একজন, যাকে ভালোবাসা সম্ভব নয়।”
নন্দিনী কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,
“তুমি জানো না, ভালোবাসার মধ্যে কোনো শর্ত নেই। কে সেই মানুষ? আমি জানতেই চাই।
মাধুরীর প্রতি ইশানের আবেগের আভাস
ইশান মৃদু কণ্ঠে বলে,
“সে একজন, যিনি আমার জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে ছিলেন। আমাকে নিজের মতো গড়ে তুলেছেন। আমি তাকে মা বলে ডাকি।”
নন্দিনী অবাক হয়ে যায়।
“মা? কিন্তু তুমি কি...?”
“হ্যাঁ,” ইশান তার কথার মধ্যে ঢুকে বলে। “আমি জানি, এটা ভুল। কিন্তু আমার অনুভূতিগুলোকে অস্বীকার করতে পারি না। আমি চেষ্টা করেছি, কিন্তু তার প্রতি আমার ভালোবাসা এমন একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, যা আমাকে প্রতিনিয়ত টেনে নিচ্ছে।”
নন্দিনী তার কথাগুলো শুনে কিছুক্ষণ চুপ থাকে। তারপর বলে,
“তুমি কখনো তার সামনে কিছু বলেছ?”
“না। আমি কখনো বলবও না। সে আমাকে শুধু একজন সন্তান হিসেবেই দেখে। আর আমি... আমি এটা বদলাতে চাই না।”
নন্দিনী কিছুক্ষণ চিন্তা করে। তারপর গভীর স্বরে বলে,
“ইশান, আমি জানি, এটা সহজ নয়। তবে আমি তোমার পাশে আছি। তোমার ভালোবাসাকে বুঝতে, তোমার জীবনের এই জটিলতাগুলোকে মিটিয়ে দিতে যা যা দরকার, আমি করব।”
ইশান মৃদু হেসে বলে,
“তুমি জানো না, তুমি কী নিয়ে জড়িয়ে পড়তে যাচ্ছ। এটা শুধু আমার জন্যই নয়, তোমার জন্যও কঠিন হয়ে উঠবে।”
“আমি জানি। কিন্তু আমি তোমাকে একা ছাড়ব না। আমি তোমার জীবনের এই অধ্যায়টা সহজ করার চেষ্টা করব।”
ষষ্ঠ অধ্যায়: মাধুরীর ছায়া এবং নন্দিনীর অনুসন্ধান
ইশানের মুখ থেকে মাধুরীর কথা শুনে নন্দিনী যেন নতুন একটি জগতের দরজা খুলে পেয়েছে। তার কৌতূহল আগের চেয়ে অনেক বেশি।
“মাধুরী! এত বড় ভূমিকা কারো জীবনে থাকতে পারে, অথচ সে নিজেও তা জানে না। এটা আমি মেনে নিতে পারি না,” মনে মনে বলে নন্দিনী।
পরের দিন নন্দিনী ইশানের সামনে এসে বলে,
“ইশান, আমি মাধুরী সম্পর্কে কিছু জানতে চাই। তিনি কেমন মানুষ?”
ইশান একটু দ্বিধায় পড়ে।
“তিনি আমার জন্য সবকিছু। তিনি এমন একজন মানুষ, যিনি আমাকে শূন্য থেকে তৈরি করেছেন। আমি যা কিছু অর্জন করেছি, সবই তার জন্য।”
“তাহলে কি তিনি তোমার কাছে শুধু একজন অভিভাবক?” নন্দিনী সরাসরি প্রশ্ন করে।
ইশান চুপ করে থাকে। তার চোখে দ্বিধার ছায়া।
নন্দিনী তার সামনে ইশানের চুপ থাকা দেখে সিদ্ধান্ত নেয়, সে নিজেই মাধুরীর সঙ্গে দেখা করবে।
“ইশান, তুমি যদি তোমার কথা বলতে না চাও, তবে ঠিক আছে। কিন্তু আমি তাকে নিজেই বুঝতে চাই।”
“নন্দিনী, এটা কি ঠিক হবে?”
“তুমি নিশ্চিন্ত থাকো। আমি তাকে কিছু বলব না। আমি শুধু জানতে চাই, এমন একজন মানুষ কেমন, যাকে তুমি এতটা ভালোবাসো।”
ইশান গভীর দৃষ্টিতে নন্দিনীর দিকে তাকায়।
“ঠিক আছে। তবে তুমি যা করবে, সেটা ভেবেচিন্তে করো। কারণ, আমি চাই না তোমার জন্য কোনো সমস্যা তৈরি হোক।”
নন্দিনী পরের সপ্তাহে মাধুরীর বাড়িতে যায়। মাধুরী তাকে আন্তরিকভাবে অভ্যর্থনা জানায়।
“তুমি নিশ্চয়ই ইশানের বন্ধু নন্দিনী?” মাধুরী তার দিকে মিষ্টি হেসে বলে।
“হ্যাঁ, আমি ইশানের খুব কাছের বন্ধু। আপনার কথা শুনেছি। তাই দেখা করতে এলাম,” নন্দিনী বলে।
মাধুরী সহজ স্বভাবের একজন মানুষ। তার হাসি আর ব্যক্তিত্বে এমন এক মায়া আছে, যা নন্দিনীকে মুগ্ধ করে।
“ইশান আমাকে তোমার কথা প্রায়ই বলে। সে তোমাকে খুব সম্মান করে। তোমার মতো বন্ধুরা সবসময় পাশে থাকুক, এটাই আমি চাই।”
নন্দিনী মাধুরীর কথা শুনে মুগ্ধ হয়।
“ইশান সত্যিই ভুল কিছু করেনি। তার এই ভালোবাসা আর মুগ্ধতার কারণ আমি এখন বুঝতে পারছি।”
নন্দিনী মাধুরীর সাথে পুরো একটা দিন কাটায়। মাধুরী সবকিছুই সে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে। ইশানের মতই নন্দিনী মাধুরীতে মুগ্ধ হয়ে যায়। মাধুরীর সঙ্গে দেখা করার পর নন্দিনী ইশানের কাছে ফিরে আসে।
“ইশান, আমি আজ তাকে দেখেছি। এখন আমি বুঝতে পারছি, কেন তুমি তাকে এতটা ভালোবাসো। তিনি সত্যিই অসাধারণ একজন মানুষ।”
ইশান কিছু বলেনি। তবে তার চোখে মাধুরীর প্রতি আরও গভীর শ্রদ্ধার আভাস ফুটে ওঠে।
“তুমি কী করবে?” নন্দিনী জিজ্ঞেস করে।
“আমি কিছু করব না। আমি তার কাছে যা আছি, তাই থাকব। আর কিছু করার অধিকার আমার নেই।”
নন্দিনী চুপ করে থাকে। তবে তার মনে একটাই সিদ্ধান্ত,
“আমি তাদের এই অসম্ভব ভালোবাসাকে বাস্তব করার জন্য লড়াই করব। ইশান এবং মাধুরীর জীবনে নতুন একটা অধ্যায় আনব।”
সপ্তম অধ্যায়: নন্দিনীর দুশ্চিন্তা এবং ইশানের সংকোচ
নন্দিনী মাধুরীর সঙ্গে দেখা করার পর থেকেই তার মনের মধ্যে নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। মাধুরীকে দেখে সে বুঝতে পারে, তিনি ইশানের জীবনে কতটা গভীরভাবে প্রভাব রেখেছেন। কিন্তু সেই ভালোবাসা যে কতটা কঠিন এবং অসম্ভব, তা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
একদিন নন্দিনী ইশানকে একান্তে ডেকে বলে,
“ইশান, আমি মাধুরীকে দেখে সত্যিই মুগ্ধ হয়েছি। কিন্তু একটা কথা বুঝি না—তুমি তাকে নিয়ে এত কিছু ভাব, অথচ তিনি তা জানেন না। তুমি কি ভেবেছ, এই অনুভূতি লুকিয়ে রাখা কতদিন সম্ভব?”
ইশান মাথা নিচু করে বলে,
“আমি জানি না। তবে আমি যা করি, সেটা সঠিক কি না, তাও বুঝি না। আমি শুধু চাই না, তিনি কষ্ট পান।”
“কিন্তু এটা কি তার প্রতি সঠিক হচ্ছে? তিনি যদি জানেন, তুমি তাকে কতটা ভালোবাসো, তাহলে হয়তো তিনি নিজেই কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন।”
ইশান কিছু বলেনি। তবে তার মনে দ্বিধার ঝড় যেন আরও তীব্র হয়ে ওঠে।
মাধুরীর উপলব্ধি
অন্যদিকে, মাধুরী নন্দিনীর আচরণে কিছুটা অস্বাভাবিকতা লক্ষ করে। নন্দিনী তাকে প্রায়ই ফোন করে খবর নেয়, তার সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা প্রকাশ করে।
“নন্দিনী খুব ভালো মেয়ে। তবে সে কেন আমার সঙ্গে এতটা আন্তরিক হচ্ছে?” মাধুরী একদিন নিজেই ভাবতে থাকে।
এক সন্ধ্যায় নন্দিনী মাধুরীর বাড়িতে যায়। গল্পের ফাঁকে মাধুরী জিজ্ঞেস করে,
“নন্দিনী, তুমি কি কিছু বলতে চাও? আমি তোমার চোখে কিছু খুঁজে পাচ্ছি, যা তুমি লুকানোর চেষ্টা করছ।”
নন্দিনী এক মুহূর্ত থেমে বলে,
“আসলে, আমি শুধু আপনার সম্পর্কে জানতে চাই। ইশান আপনার জন্য কতটা গুরুত্ব রাখে, তা বুঝতে পারি। আপনাকে দেখে মনে হয়, আপনি তার জীবনে মা এবং বন্ধুর মতো।”
মাধুরী একটু হাসে।
“ইশান আমার একমাত্র সন্তান, আমরা একমাত্র আশার আলো। সে সত্যিই আমাকে অনেক সম্মান করে। আমি তার জন্য গর্বিত।”
নন্দিনী কিছু বলে না। তবে তার মনে একটাই কথা,
“আপনি যা ভাবছেন, সেটা হয়তো ঠিক, তবে ইশানের মনের ভাব পুরোপুরি আপনি বুঝতে পারছেন না।”
নন্দিনীর প্রতিজ্ঞা
নন্দিনী মাধুরীর সঙ্গে প্রতিদিন আরও বেশি সময় কাটাতে থাকে। সে বুঝতে পারে, মাধুরী এবং ইশানের সম্পর্ক যতটা গভীর, ততটাই জটিল।
“ইশান যা অনুভব করে, সেটা ঠিক। কিন্তু সমাজের এই ভীতিকর দেয়াল ভাঙতে হলে সাহস দরকার। আমি ইশানের পাশে থাকব এবং তাকে সেই সাহস জোগাব।”
নন্দিনী ইশানের সামনে এসে বলে,
“তুমি যদি নিজে থেকে কিছু না করো, তাহলে আমি মাধুরীর সঙ্গে সরাসরি কথা বলব।”
ইশান চমকে যায়।
“তুমি এটা করবে না, নন্দিনী। আমি চাই না, তার সামনে এই বিষয়টি আসুক।”
“তাহলে তুমি নিজে বলো। এটা তোমার ভালোবাসা, ইশান। যদি সাহস না পাও, তবে সেই ভালোবাসাকে মানাও না।”
নন্দিনীর চ্যালেঞ্জ ইশানের মনে গভীর আলোড়ন তোলে। একদিকে তার মনের গভীর ভালোবাসা, অন্যদিকে মাধুরীর প্রতি তার অগাধ শ্রদ্ধা। এসবের মধ্যে নিজের অনুভূতিগুলোকে প্রকাশ করা তার কাছে প্রায় অসম্ভব মনে হয়।
কিন্তু নন্দিনীর জেদ এবং অকপট কথাগুলো ইশানকে ভাবতে বাধ্য করে।
“আমার অনুভূতিগুলোকে এভাবে চেপে রাখা কি মাধুরীর প্রতি অবিচার? তিনি যদি জানেন, তবে হয়তো আমাদের সম্পর্ক আরও গভীর হতে পারে। অথবা... হয়তো সব কিছু শেষ হয়ে যেতে পারে। আমি কী করব?”
মাধুরীর জীবনের গল্পটা সহজ ছিল না। ইশানের বাবা যখন আকস্মিক দুর্ঘটনায় মারা যান, তখন ছোট্ট ইশানকে মাধুরী নিজের কাছে আঁকড়ে ধরে রাখেন।
“ইশান আমার একমাত্র সন্তান। ইশান তার স্মৃতির জীবন্ত অংশ,” মাধুরী প্রায়ই একাকী এসব ভাবতেন।
কিন্তু বয়স এবং অভিজ্ঞতা মাধুরীকে বাস্তববাদী করে তুলেছে। তিনি জানেন, সমাজের চোখে তার এবং ইশানের সম্পর্ক কখনোই সহজভাবে গৃহীত হবে না।
এদিকে নন্দিনী বুঝতে পারে, ইশান সাহস করে এগোতে পারছে না। সে একদিন মাধুরীর সঙ্গে সরাসরি কথা বলার সিদ্ধান্ত নেয়।
“মাধুরী আন্টি, আপনি কি কখনো ভেবেছেন, ইশানের জীবনে আপনি কতটা গুরুত্বপূর্ণ?” নন্দিনী সরাসরি প্রশ্ন করে।
মাধুরী একটু থমকে যান।
“তুমি হঠাৎ এ কথা বলছ কেন, নন্দিনী?”
“কারণ, আমি চাই আপনি জানুন। ইশান আপনাকে যা ভাবেন, তা একজন সাধারণ মা বা অভিভাবকের চেয়ে অনেক বেশি। আমি জানি, এটা বলা সহজ নয়, কিন্তু সত্যি লুকিয়ে রাখাও তো ঠিক নয়।”
মাধুরী স্তব্ধ হয়ে যান। তার মনে যেন ঢেউ খেলে যায়।
“তুমি যা বলছ, সেটা কি সত্যি? কিন্তু আমি তো কখনো এমন কিছু লক্ষ করিনি...”
“তবুও, আপনি ভাবুন। ইশানের জন্য এটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে, সেটা একবার বুঝতে চেষ্টা করুন।”
নন্দিনীর এই পদক্ষেপ ইশানকে সাহস দেয়। সে মাধুরীর সামনে গিয়ে ধীরে ধীরে বলে,
“আপনি আমার জীবনের সবকিছু। কিন্তু শুধু মা নয়... আরও অনেক বেশি। আমি জানি, এটা বলা ঠিক নয়। কিন্তু আমি আর নিজের অনুভূতিগুলোকে লুকিয়ে রাখতে পারছি না।”
মাধুরী কিছুক্ষণ চুপ থেকে ইশানের দিকে তাকিয়ে থাকেন। তার চোখে জল জমে।
“ইশান, তুমি কি জানো, তুমি কী বলছ? আমি তোমার কাছে সবসময় একজন অভিভাবক ছিলাম। তুমি আমাকে এমনভাবে দেখ, সেটা আমি কখনো ভাবিনি।”
“আমি জানি। কিন্তু আমি আমার মনের কথা বলতে বাধ্য হলাম। কারণ, আপনাকে ছাড়া আমার জীবন শূন্য।”
মাধুরী এক গভীর চিন্তায় ডুবে যান। একদিকে ইশানের প্রতি তার ভালোবাসা, অন্যদিকে সমাজের বিধি-নিষেধ। তিনি বুঝতে পারেন, এই সম্পর্ক সহজ হবে না। কিন্তু ইশানের সাহস তাকে একটি নতুন দিক নিয়ে ভাবতে বাধ্য করে।
“তুমি আমাকে সময় দাও, ইশান। আমি এই অনুভূতিগুলো নিয়ে ভাবতে চাই। আমার জন্যও এটা সহজ নয়,” মাধুরী অবশেষে বলেন।
অষ্টম অধ্যায়: মাধুরীর একাকী রাত এবং ইশানের প্রতিচ্ছবি
রাত গভীর। মাধুরী নিজের ঘরে একা বসে আছে। জানালার পাশে রাখা চেয়ারে হেলান দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। শীতল বাতাস তার চুলের ভেজা ডগাগুলোকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, যেন রাতের আকাশও তার মতোই অস্থির।
ইশানের কথা সে ভুলতে পারছে না।
“ও আজ যা বলল... সেটা কি সত্যি? নাকি আমি ভুল শুনেছি?”
তার মনের মধ্যে ইশানের সেই সাহসী স্বীকারোক্তি বারবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।
“আপনি আমার জীবনের সবকিছু। কিন্তু শুধু মা নয়... আরও অনেক বেশি।”
মাধুরী চোখ বন্ধ করে গভীরভাবে শ্বাস নেয়। ইশানের চেহারা, তার চোখের গভীরতা, তার কণ্ঠস্বর... সব কিছু যেন তার মনে স্পষ্ট হয়ে ভেসে উঠছে।
“ইশান আমার সন্তান। ওকে ছোট থেকে বড় করেছি। কিন্তু... কেন আজ ওর কথা শুনে আমার মনে অন্যরকম একটা অনুভূতি হলো?”
মাধুরী জানে, ইশানের এই কথা সমাজ মেনে নেবে না। তার নিজের মনও মেনে নিতে অস্বস্তি বোধ করছে, কারণ সে মা। কিন্তু সেই সঙ্গে সে এটাও অনুভব করছে, ইশানের প্রতি তার ভালোবাসা শুধুই অভিভাবকের মতো নয়।
“ইশান কি সত্যিই আমাকে এইভাবে দেখে? আমি কি তার যোগ্য? আর যদি যোগ্যও হই, তবে সমাজ কী বলবে? মানুষ কি আমাকে দোষ দেবে? ওর ভবিষ্যৎ কি নষ্ট হয়ে যাবে আমার জন্য?”
এই চিন্তাগুলো তাকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। সে নিজের মনের অবস্থা বুঝতে পারছে না।
অন্যদিকে, ইশান নিজের ঘরে শুয়ে আছে। নন্দিনী এবং মাধুরীর সঙ্গে হওয়া কথাগুলো তার মাথায় ঘুরছে।
“আমি ঠিক করেছি তো? নন্দিনী ঠিকই বলেছিল। মাধুরীর প্রতি আমার এই অনুভূতি লুকিয়ে রাখা মানে তার সঙ্গে অবিচার করা। কিন্তু তিনি কি কখনো আমাকে সেইভাবে দেখবেন?”
তার মনে একটাই ভয়,
“যদি তিনি আমাকে ভুল বুঝেন? যদি আমাকে দূরে সরিয়ে দেন?”
ওদিকে নন্দিনী সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সে আর অপেক্ষা করবে না। ইশান এবং মাধুরী দু’জনেই যে একে অপরের প্রতি কিছু অনুভব করে, সেটা তার কাছে স্পষ্ট।
“সমাজের চিন্তা করলে জীবন চলবে না। আমি জানি, মাধুরী আন্টি এবং ইশান একসঙ্গে থাকলে দু’জনেই সুখী হবে। এখন শুধু ওদেরকে সেই সাহসটা দিতে হবে।”
পরদিন সকালে নন্দিনী ইশানকে ডেকে বলে,
“আজ মাধুরীর সঙ্গে আবার দেখা করতে হবে। আমি চাই, তুমি তাকে স্পষ্ট করে বোঝাও যে তুমি এই সম্পর্ক নিয়ে সিরিয়াস। শুধু ভালোবাসা বললে হবে না, তাকে বোঝাও যে তুমি ভবিষ্যতেও তার পাশে থাকতে চাও।”
ইশান দ্বিধায় পড়ে।
“তুমি কি বুঝতে পারছ, আমি কতটা ভয় পাচ্ছি?”
“ভয় পেতে থাকলে তুমি হারবে। ভালোবাসা সাহসীদের জন্য। তুমি যদি তাকে সত্যিই ভালোবাসো, তবে সাহস নিয়ে এগিয়ে যাও।”
ইশান বাড়িতে গিয়ে দেখে, মাধুরী বারান্দায় বসে আছেন। তার মুখে একধরনের অস্থিরতা। ইশান ধীরে ধীরে তার সামনে গিয়ে বসে।
“মা, আমি জানি, কাল রাতে আমার কথা শুনে আপনি অস্বস্তি বোধ করেছেন। কিন্তু আমার মন যা বলে, তা আপনার কাছে লুকানো ঠিক হবে না। আমি জানি, এটা বলা সহজ নয়। কিন্তু আমি আপনাকে ভালোবাসি। আর শুধু এই সমাজের জন্য সেটা ভুল বলে মেনে নিতে পারি না।”
মাধুরী চুপ করে থাকে। তার চোখে জল জমে।
“ইশান, তুমি যা বলছ, তা সহজ নয়। আমি জানি, তুমি সত্যি কথা বলছ। কিন্তু আমাদের এই সম্পর্ক মেনে নেওয়া কি সম্ভব?”
মাধুরীর সিদ্ধান্তের দ্বন্দ্ব
মাধুরী চুপচাপ বারান্দার চেয়ারে বসে আছেন। ইশানের শেষ কথাগুলো তার মনে বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে।
“আমি আপনাকে ভালোবাসি। আর শুধু এই সমাজের জন্য সেটা ভুল বলে মেনে নিতে পারি না।”
তার চোখে জল জমে, কিন্তু সেটা আটকে রাখার চেষ্টা করে। নিজের হাত মুঠো করে রাখেন। মনে হচ্ছে, যেন ভেতরে কোনো ঝড় বইছে।
মাধুরীর একাকী ভাবনা
সন্ধ্যার দিকে মাধুরী নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেন। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে একবার দেখে নেন।
“এই আমি, যার চুলে অর্ধেক সাদা। বয়স পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই। আর সে, যে এখনো নিজের ভবিষ্যতের পথে হাঁটতে শুরু করেছে। কীভাবে সম্ভব এই সম্পর্ক?”
মাধুরী নিজেকে নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়েন। ইশানের প্রতি তার মনের গভীরে অন্যরকম একটি অনুভূতি যে জন্ম নিয়েছে, তা সে অস্বীকার করতে পারে না। কিন্তু সেটি স্বীকার করার সাহসও তার নেই।
“ইশান কি আমাকে সত্যিই ভালোবাসে? নাকি তার এই অনুভূতি সাময়িক? আর যদি সত্যিই ভালোবাসে, তবে আমি কি তার যোগ্য?”
অন্যদিকে, ইশান নন্দিনীর কাছে গিয়ে নিজের অস্থিরতা প্রকাশ করে।
“নন্দিনী, আমি জানি না মাধুরী আমার কথা কীভাবে নিচ্ছে। তার চোখে আমি কি এখনো ছোট সেই ইশান, যে তার স্নেহে বড় হয়েছে?”
নন্দিনী ইশানের কাঁধে হাত রেখে বলে,
“তুমি এত অস্থির হলে হবে না। মাধুরী আন্টি সময় নিচ্ছেন কারণ তার নিজের মনের সঙ্গেও লড়াই চলছে। তুমি যদি সত্যিই তাকে ভালোবাসো, তবে ধৈর্য ধরো। তার বিশ্বাস অর্জন করো।”
পরের দিন সকালে, নন্দিনী মাধুরীর বাড়িতে যায়। মাধুরী তাকে দেখে একটু বিস্মিত হন।
“নন্দিনী! এত সকালে?”
“হ্যাঁ, আন্টি। আপনার সঙ্গে কথা বলতে এসেছি। ইশানের ব্যাপারে।”
মাধুরী তার হাতের বইটা রেখে বলে,
“ইশানের ব্যাপারে? কেন?”
“কারণ, ইশানের অনুভূতিগুলো আপনি বুঝতে পারছেন কি না, সেটা আমি জানতে চাই।”
মাধুরী নীরব হয়ে যান। কিছুক্ষণ পর বলেন,
“নন্দিনী, আমি বুঝতে পারছি, ইশান আমাকে ভালোবাসে। কিন্তু তুমি কি বুঝতে পারছ আমি তার মা, ইশান আমার নিজের সন্তান, এই সম্পর্ক কতটা অসম্ভব?”
নন্দিনী সোজাসাপ্টা জবাব দেয়,
“অসম্ভব নয়, আন্টি। আপনি শুধু সমাজের ভয় পাচ্ছেন। কিন্তু যদি সমাজকে সরিয়ে রেখে ভাবেন, আপনি একজন নারী, ইশান একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ, আপনি কি সত্যিই ইশানের ভালোবাসা ফিরিয়ে দিতে চান না?”
মাধুরী চুপ করে থাকেন। তার চোখে জল জমে যায়।
মাধুরী নন্দিনীর সরাসরি প্রশ্নে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। তার কণ্ঠ কিছুটা কাঁপছিল।
“তুমি কি বোঝো, এই সম্পর্ক মানে কী? ইশানের ভবিষ্যৎ কি আমি নষ্ট করে দিতে পারি? আমি তার কাছে কতটা বড় দায়িত্ব, সেটা তুমি বুঝতে পারো?”
নন্দিনী হেসে বলে,
“আপনি জানেন না, ইশানের ভবিষ্যৎ কেবল আপনিই। সে আপনার জন্যই জীবনটা সুন্দরভাবে দেখতে চায়। আপনি যদি নিজেকে দূরে সরিয়ে নেন, সে ভেঙে পড়বে।”
মাধুরী মাথা নিচু করে ফিসফিস করে বলল,
“তাহলে কি তুমি বলছ, আমি আমার বয়স, দায়িত্ব, আর সমাজের ভয় সবকিছু ভুলে গিয়ে তার পাশে দাঁড়াই?”
নন্দিনী দৃঢ়ভাবে উত্তর দিল,
“হ্যাঁ। আপনি যদি তাকে ভালোবাসেন, তবে সবকিছু ভুলে যান। সমাজ নিয়ে চিন্তা করবেন কেন? ইশান কারো দয়া চায় না। সে শুধু আপনাকে পাশে চায়।”
ইশান জানে, নন্দিনী মাধুরীর সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছে। সে বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে মাধুরীর বাড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। তার মনের মধ্যে একরাশ অস্থিরতা।
“নন্দিনী কি তাকে বোঝাতে পারবে? মাধুরী কি কখনো আমাকে সেইভাবে দেখবে?”
কিছুক্ষণ পর নন্দিনী ফিরে আসে। তার মুখে এক ধরনের আত্মবিশ্বাসের ঝলক।
“মাধুরী আন্টি এখনো দ্বিধায় আছেন, কিন্তু আমি জানি, তার মনের দেয়াল ধীরে ধীরে ভাঙছে। তুমি শুধু সময় দাও।”
ইশান এবার নন্দিনীকে বলে,
“আমি জানি, আমাদের সম্পর্ক মেনে নেওয়া সহজ হবে না। কিন্তু আমি মাধুরীর সঙ্গে থাকতেই চাই। আর যদি সেটা করার জন্য সমাজের সামনে দাঁড়াতে হয়, তবে তাই করব।”
নন্দিনী তাকে সমর্থন জানায়।
“তোমার এই সাহসটাই ওর দরকার, ইশান। ওকে বুঝিয়ে দাও যে তুমি এই লড়াইয়ে একা নয়, ওকেও সঙ্গে চাইছ।”
নবম অধ্যায়: সিদ্ধান্তের সন্ধিক্ষণ
মাধুরী একা বসে আছেন। নন্দিনীর কথা তার মনে বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে।
“আপনি যদি তাকে ভালোবাসেন, তবে সবকিছু ভুলে যান। সমাজ নিয়ে চিন্তা করবেন কেন?”
জীবনে বহু সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। ইশানকে কোলেপিঠে করে ছোট থেকে বড় করেছেন। তার জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে মাধুরীর ভূমিকা ছিল মা, অভিভাবক, সুরক্ষাকারীর। কিন্তু আজ, সেই ইশানের জন্য তার নিজের মনের সঙ্গে লড়াই করতে হচ্ছে।
“আমার কি এই অধিকার আছে? সমাজ আমাকে কখনো গ্রহণ করবে না। ইশান? সে কি সত্যিই এই সম্পর্কের জন্য লড়াই করতে পারবে?”
অন্যদিকে, ইশান মাধুরীর দ্বিধা বুঝতে পারছে। সে নন্দিনীকে ডেকে বলে,
“আমি আর অপেক্ষা করতে পারছি না। মাধুরী যদি আমাকে কখনো না বলে দেয়, তবে হয়তো আমি ভেঙে পড়ব। আমি জানি, সে আমাকে ভালোবাসে। কিন্তু তার ভয়গুলো তাকে আটকে রেখেছে।”
নন্দিনী কিছুক্ষণ চুপ থাকে, তারপর বলে,
“তাহলে এবার ওকে বোঝাও যে তুমি সত্যিই তার পাশে থাকতে চাও। কোনো দ্বিধা ছাড়াই। ওকে সাহস দাও। সমাজের কাছে তোমাদের ভালোবাসার মূল্য প্রতিষ্ঠা করতে হলে তোমাকেই এগিয়ে যেতে হবে।”
অনেক চিন্তা ভাবনার পর, মাধুরী পরদিন সন্ধ্যায় নন্দিনীর সঙ্গে একান্তে কথা বলেন।
“নন্দিনী, তোমরা তরুণ। তোমাদের সামনে জীবন। কিন্তু আমার?”
“আপনারও জীবন আছে, আন্টি। সেটা কখনো শেষ হয়ে যায়নি। সমাজের নিয়ম মানেই কি সবসময় সঠিক? যদি ইশান আপনার পাশে থাকতে চায়, তবে কেন আপনার ভয়?”
মাধুরী নন্দিনীর কথাগুলো শুনে কিছুটা থেমে যায়। তার চোখে জল জমে, কিন্তু চুপ করে থাকেন।
হঠাৎই ইশান এবার সরাসরি মাধুরীর সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।
“মা, আমি আর অপেক্ষা করতে পারছি না। আপনি যদি আমাকে মেনে নিতে না চান, তবে বলুন। আমি সবকিছু ছেড়ে চলে যাব। কিন্তু আমি আপনাকে শুধু একজন মা হিসেবে নয়, আমার জীবনের সবকিছু হিসেবে দেখি। আপনি কি আমাকে সেই অধিকার দেবেন?”
মাধুরী এবার আর নিজেকে আটকাতে পারেন না। তার চোখ থেকে টপটপ করে জল ঝরতে থাকে।
“ইশান, আমি জানি না, এই সম্পর্ক কতটা সঠিক। কিন্তু আমি জানি, আমি তোমাকে হারাতে চাই না।”
মাধুরী একটু অস্বস্তি বোধ করছেন, কিন্তু ইশান তাকে স্বাভাবিক করার জন্য তার হাত ধরে বলে,
“আপনার ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমি আছি আপনার পাশে। আর কিছু নিয়ে ভাবতে হবে না।”
মাধুরী কিছু বলতে গিয়ে থেমে যায়। ইশান তার দিকে তাকিয়ে বলে,
“আপনার মনে যা আছে, সব বলতে পারেন। আমি শুনতে চাই।”
মাধুরী গভীর নিশ্বাস নিয়ে বলে,
“ইশান, আমি শুধু ভয় পাচ্ছি। সমাজের কথা, তোমার ভবিষ্যৎ... আমার বয়স। এসব নিয়ে।”
ইশান একটু হাসি দিয়ে বলে,
“আপনি কি জানেন, এসব কিছুর থেকেও বড় একটা জিনিস আছে? সেটি হলো ভালোবাসা। আর আমি আপনাকে ভালোবাসি, মা। আপনি যদি আমাকে বিশ্বাস করেন, তবে আমরা সবকিছু পার করতে পারব।”
মাধুরী এক মুহূর্তের জন্য নীরব থাকেন। তারপর ধীরে ধীরে বলেন,
“আমি তোমার ভালোবাসা মেনে নিচ্ছি, ইশান। তবে আমি জানি না, সমাজ কীভাবে এটাকে দেখবে।”
নন্দিনী ইশানকে বলে,
“এখন যেহেতু মাধুরী আন্টি তোমাকে মেনে নিয়েছেন, তোমাদের সম্পর্ককে মজবুত করার সময় এসেছে। কিন্তু মনে রেখো, সমাজে তোমাদের লড়াইটা সহজ হবে না। আমরা এর জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে।”
মাধুরী একটু চিন্তিত স্বরে বললেন,
“তোমরা দুজন তরুণ, কিন্তু আমি কীভাবে এই লড়াইয়ে টিকে থাকব? সমাজের প্রতিটি মানুষ আমাদের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলবে। আমি জানি না, আমরা কীভাবে এটা সামলাব।”
ইশান তার হাত চেপে ধরে বলল,
“আপনার শক্তিই আমার শক্তি। আমি জানি, সমাজ কঠিন হবে, কিন্তু আমরা একসঙ্গে থাকলে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়।”
নন্দিনী মুচকি হেসে বলল,
“তোমরা দুজনের সাহসই এই লড়াইয়ের ভিত্তি। কিন্তু আমাদের কিছু কৌশল দরকার। আমরা কীভাবে সমাজের সামনে নিজেদের ভালোবাসা সঠিকভাবে তুলে ধরব, তা ঠিক করতে হবে।”
মা ছেলের ভালোবাসার সম্পর্ক নিয়ে সমাজের কঠিন প্রশ্ন
তারা তিনজন মিলে সম্ভাব্য প্রশ্নগুলো নিয়ে আলোচনা শুরু করলেন:
1. বয়সের পার্থক্য:
মাধুরী বলে,
“সবাই প্রথমেই আমাদের বয়স নিয়ে কথা বলবে। আমি কীভাবে তাদের বোঝাব যে ভালোবাসা বয়স দেখে হয় না?”
নন্দিনী উত্তর দেয়,
“তাদের বোঝানোর দরকার নেই। আমাদের শুধু আমাদের ভালোবাসার দৃঢ়তা দেখাতে হবে। সমাজ ধীরে ধীরে বুঝবে।”
2. পরিবারের অন্যান্যদের অসম্মতি:
ইশান বলে,
“আমাদের পরিবারের কেউ কি আমাদের এই সম্পর্ক মেনে নিবে? তাদের সমর্থন ছাড়া আমরা কি এগোতে পারব?”
নন্দিনী বলে,
“তাদেরকে সময় দাও। তারা এই সিদ্ধান্তে হয়তো প্রথমে ভরসা করবে না, কিন্তু তোমাদের প্রতিজ্ঞা দেখে তারা একদিন তোমার পাশে দাঁড়াবে।”
3. সমাজের বিদ্রূপ:
মাধুরী বলে,
“মানুষ আমাদের নিয়ে যা খুশি বলবে।কারণ আমরা মা ছেলে। মা ছেলেতে এই ধরনের সম্পর্ক হয়না। সমাজ বলো, রাষ্ট্র বলো কেউ এটা মেনে নিবে না।
ইশান দৃঢ়ভাবে বলে,
“আপনি শুধু আমার ওপর ভরসা রাখুন। আমি সবকিছু সহ্য করব, কিন্তু আপনাকে কখনো একা হতে দেব না।”
লড়াইয়ের পরিকল্পনা
নন্দিনী তাদের একটি পরামর্শ দেয়,
“আমরা কয়েকজন ইন্সেস্ট মতাদর্শে বিশ্বাসী এবং উদার ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলব। তারা আমাদের সমর্থন করতে পারে। এরপর আমরা ধীরে ধীরে আমাদের গল্পটা সমাজের সামনে তুলে ধরব।”
মাধুরী একটু কাঁপা কাঁপা স্বরে বললেন,
“তাহলে কি আমরা এই লড়াইয়ে সত্যিই জয়ী হতে পারব?”
ইশান মুচকি হেসে বলে,
“জয়-পরাজয় বড় কথা নয়, মাধুরী। বড় কথা হলো, আমরা একসঙ্গে লড়াই করছি। এটাই আমাদের সম্পর্কের সবচেয়ে বড় শক্তি।”
নন্দিনী এক কাপ চা হাতে নিয়ে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ইশান আর মাধুরীর দিকে তাকিয়ে ছিল। তাদের সম্পর্ক নিয়ে যে সমাজের সামনে দাঁড়ানোর কথা ভাবা হচ্ছিল, নন্দিনী হঠাৎ সেই ভাবনাটাই বদলে ফেলে।
“তোমরা সমাজকে বোঝানোর জন্য সময় নষ্ট করবে কেন? ভালোবাসা কখনো প্রমাণের বিষয় নয়। তোমাদের যা করতে হবে, তা হলো নিজেদের ভালোবাসার সম্পর্কটাকে নিজেদের মতো করে চালিয়ে যাওয়া,” নন্দিনী শান্ত কণ্ঠে বলল।
ইশান অবাক হয়ে বলে,
“তাহলে আমরা সবকিছু গোপন রাখব?”
নন্দিনী মাথা নাড়ল।
“গোপন রাখবে না, তবে দেখাতেও যাবে না। মানুষ যা জানে না, তা নিয়ে বেশি কিছু করতে পারে না। তোমরা নিজেদের মতো করে ভালো থাকো। সমাজের জন্য অপেক্ষা করা বৃথা।”
মাধুরী নন্দিনীর কথাগুলো শুনে কিছুটা স্বস্তি পেলেন। এতদিন তিনি সমাজের চাপ নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। কিন্তু নন্দিনীর সহজ কথাগুলো যেন তার মনে সাহস এনে দিল।
“তাহলে আমরা আর কাউকে কিছু বলব না। ইশান, আমাদের সম্পর্কটা আমাদের মতো করেই থাকুক। তবে তুমি জানো, এ পথে অনেক চ্যালেঞ্জ আসবে,” মাধুরী বললেন।
ইশান দৃঢ়ভাবে মাধুরীর দিকে তাকিয়ে বলল,
“আপনি শুধু আমার পাশে থাকুন। আমি সবকিছু মেনে নেব, সবকিছুর মোকাবিলা করব। আপনার ভালোবাসার জন্য আমি সব কিছু করতে পারি।”
তারা ধীরে ধীরে নিজেদের সম্পর্কের আড়ালে নতুন একটি সম্পর্ক তৈরি করল। সমাজের চোখে সাধারণ সম্পর্ক ধরে রাখার চেষ্টা। একে অপরের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ শুধু নির্জনে, যেখানে কেউ দেখতে পাবে না। পরিবারের সামনে একে অপরকে সম্মান দেওয়া, যেন তারা কোনো সন্দেহ না করে।
মাধুরী মাঝে মাঝে নিজেকে দোষ দিতেন।
“আমি কি তোমার জীবনের প্রতি অন্যায় করছি, ইশান?”
ইশান সবসময় হাসি দিয়ে বলত,
“মা, আপনার সঙ্গে থাকা মানেই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ন্যায্যতা।”
দশম অধ্যায়: গোপন সম্পর্কের গভীরতা
তারা একে অপরের সঙ্গে আরও বেশি সময় কাটাতে শুরু করল। ইশান মাঝে মাঝে মাধুরীর হাত ধরে বলত,
“আমাদের ভালোবাসার পথটা হয়তো অন্যদের মতো সহজ নয়। কিন্তু এটা আমাদের নিজেদের পথ। আপনি কি আমার সঙ্গে সারাজীবন থাকতে পারবেন?”
মাধুরী তার হাত ধরে মৃদু হাসি দিয়ে বলতেন,
“তোমার সাহসটাই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে, ইশান। আমি সবসময় তোমার পাশে থাকব।”
ইশান আর মাধুরী তাদের গোপন সম্পর্কের মধ্যে এক নতুন ছন্দ খুঁজে পায়। দিনের আলোতে তারা সমাজের চোখে স্বাভাবিক আচরণ করত, কিন্তু রাতের নীরবতায় তাদের ভালোবাসা গভীরভাবে প্রকাশ পেত।
একদিন সন্ধ্যায়, নন্দিনী ইশানের ঘরে এসে বলে,
“তোমরা দুজনই খুব সাবধান। কিন্তু ইশান, এই গোপনীয়তা তোমাদের জন্য কতটা দীর্ঘস্থায়ী হবে? কোনো ভুল হলে সমাজের চোখে ধরা পড়তে খুব বেশি সময় লাগবে না।”
ইশান কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
“তুমি ঠিক বলেছ, নন্দিনী। কিন্তু আমরা আর কোনো বিকল্প দেখছি না। ভালোবাসা প্রকাশ করলে সমাজ তা মেনে নেবে না, আর লুকিয়ে থাকলে ভয় সবসময় পিছু নেবে। আমাদের এই দ্বন্দ্বের মধ্যেই থাকতে হবে।”
ইশানের মনে তখন এক নতুন দ্বন্দ্ব শুরু হয়। মাধুরীর প্রতি তার ভালোবাসা যেমন গভীর, তেমনই এই সম্পর্ক নিয়ে তার দুশ্চিন্তাও কম নয়। এক রাতে, মাধুরী ইশানের মনোভাব বুঝতে পেরে জিজ্ঞেস করেন,
“তোমার চোখে যে দুশ্চিন্তা, তা কেন? আমি কি তোমার জন্য বোঝা হয়ে গেছি?”
ইশান চমকে উঠে বলে,
“আপনি আর কোনদিন এ ধরনের কোন কথা বলবেন না, মা। আপনি আমার সবকিছু। আমি শুধু ভাবছি, আমাদের ভালোবাসাকে কীভাবে আরও সুরক্ষিত করা যায়।”
মাধুরী মৃদু হাসি দিয়ে বলে,
“ভালোবাসা কোনোদিন সুরক্ষিত করার প্রয়োজন হয় না, ইশান। ভালোবাসা হলো বিশ্বাস। তুমি যদি বিশ্বাস রাখো, তাহলে আর কোনো কিছুই প্রয়োজন নেই।”
নন্দিনী সবসময় তাদের পাশে ছিল। তাদের জন্য ছোটখাটো পরিকল্পনা করত, যাতে তারা নিজেদের সম্পর্ক আরও সুন্দরভাবে বজায় রাখতে পারে। একদিন নন্দিনী মাধুরীকে বলে,
“আপনি ইশানের জন্য শুধু একজন ভালোবাসার মানুষ নন। আপনি তার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রেরণা। আপনাকে শক্ত থাকতে হবে।”
মাধুরী নন্দিনীর কথা শুনে তার হাত চেপে ধরে বলে,
“তোমার মতো একজন বন্ধু ছাড়া আমাদের এই লড়াই অসম্ভব হয়ে যেত। তুমি সবসময় আমাদের পাশে থেকো।”
নন্দিনী মুচকি হেসে বলে,
“তোমাদের ভালোবাসার জন্য আমি সবসময় আছি। তবে তোমরা সাবধান থেকো। সমাজের চোখ খুব তীক্ষ্ণ।”
একদিন বিকেলে, মাধুরী আর ইশান বসে চা খাচ্ছিল। নন্দিনী তাদের কাছে এসে বলল,
“তোমরা দুজনই এমন খুঁতখুঁতে, মনে হয় ছোট ছোট শিশুদের মতো খুনসুটি করছো। কখনো ভাবো, বাইরের লোক কীভাবে দেখে?”
মাধুরী মুচকি হেসে বলেন,
“নন্দিনী, বাইরে লোক কীভাবে দেখবে সেটা আমার কিছুই আসে যায় না। আমি তো শুধু ইশানের সঙ্গে থাকতে ভালোবাসি।”
ইশান অবাক হয়ে মাধুরীর দিকে তাকিয়ে বলে,
“আসলে মা তো একেবারে শিশুর মতো। কিছু বললেই বলে, ‘ও আমাকে ভালোবাসে, আমি তাকে ভালোবাসি,’ কোনো ভয় বা চিন্তা নেই। এমনকি, মা হয়ে থেকেও বেশ আদুরে।”
মাধুরী হাসি থামিয়ে ইশানকে ঠেল দিয়ে বলে,
“তুমি নিজেও তো শিশু! তোমার একটা ছোট্ট ভুলে মাথার ওপর একটা ছোট্ট রাগ ঝড়ে যায়, আর তারপর আমাকে নিয়ে খুনসুটি করছো।”
নন্দিনী হাসতে হাসতে বলে,
“দেখো, আমি যেটা বলছি তা হলো, তোমরা দুজনই এমন একটা সম্পর্ক তৈরি করেছো, যে সম্পর্ক মা-ছেলের এবং প্রেমিক-প্রেমিকার মতো সুন্দর। এমন সম্পর্ক দেখতে পাওয়াটাও বিরল।”
ইশান একটু বিরক্তি নিয়ে বলে,
“তোমার কি মনে হয়, মা আমাকে ‘ভালোবাসি’ বললেই সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে?”
মাধুরী মুচকি হেসে বললেন,
“ইশান, তুমি জানো না। কিছু মানুষ থাকে, যারা ভালোবাসা প্রকাশ করতে পারলেও সেটাকে বিশ্বাস করে না। তোমার মতো তো আমি সবসময় বিশ্বাস করতে পারি। তুমি যখন একটা হাসি দিলে, তখন আমি জানি তুমি ঠিক আছো।”
ইশান মৃদু হাসে,
“তুমি জানো না, মা, কখনো কখনো আমি তোমার মতো কাউকে চুমু খেতে চাই, শুধু তোমার হাসির জন্য।”
মাধুরী একটু লজ্জিত হয়ে মাথা নামিয়ে দেয়,
“ওহ, তুমি আবার কি বলছো? এমন কথা বললে আমি কি করব?”
নন্দিনী হেসে উঠে বলে,
“তোমরা দুজনের মধ্যেই আমি কমেডি দেখতে পাচ্ছি! একে অপরকে এত ভালবাসলেও কখনো মাকে ছেলে হিসেবে, কখনো প্রেমিক হিসেবে দেখছো! কি সুন্দর!”
মাধুরী চোখ পাকিয়ে নন্দিনীকে বললেন,
“তুমি যদি আমাদের সম্পর্ক নিয়ে আরও কথা বলো, তাহলে বুঝবে কে কোথায় দাঁড়িয়ে আছে।”
ইশান মৃদু হাসে এবং মাধুরীকে কোলে তুলে বলে,
“তুমি কি কখনো জানবে না, আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি?”
মাধুরী নীরবে মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন,
“এত ভালোবাসা দেখিয়ে তুমি কিন্তু আমার কাজটা বাড়িয়ে দিচ্ছো।”
এই সময়, নন্দিনী হঠাৎ বলে ওঠে,
“ওহ, আমি তো ভুলেই গেছি! তোমাদের খুনসুটির মধ্যে দিয়ে একটা ব্যাপার ঠিক করতে হবে। তোমরা দুজন কি আসলেই একে অপরকে খুব ভালোবাসো?”
ইশান মুচকি হেসে বলল,
“যতক্ষণ মা আমার পাশে আছে, আমি একে অপরকে ভালোবাসতে পারব। আমি তো জানি, মাই আমার জন্য সবকিছু।”
মাধুরী তার দিকে মিষ্টি করে তাকিয়ে বললেন,
“তুমি সব সময় এটা বলো, ইশান। কিন্তু আমাকে কখনো ছাড়তে পারবে না, তাই না?”
এভাবে তাদের খুনসুটি চলতে থাকে, এবং নন্দিনী মাঝে মাঝে হাসতে হাসতে বলে,
“এভাবেই ভালোবাসা জীবনকে মধুর করে তোলে।”
এর মধ্যেই হঠাৎ নন্দিনী বলে,
“তোমরা যদি সত্যিই একে অপরকে এতটা ভালোবাসো, তাহলে এক কাজ করো—বিয়ে করে ফেলো।”
ইশান এবং মাধুরী দুজনেই হতবাক হয়ে যায়। ইশান প্রথমেই বলে,
“বিয়ে! কিন্তু আমরা কীভাবে? এটা তো অসম্ভব। সবাই জানলে বড় বিপদ হবে।”
নন্দিনী তার কথার মাঝেই বলে,
“তোমাদের ভালোবাসা যদি সত্য হয়, তবে এটাকে সামাজিকভাবে বৈধ করার জন্য বিয়েটাই একমাত্র উপায়। আমাদের তিনজন ছাড়া আর কেউ জানবে না। চুপচাপ বিয়েটা সেরে নিও। আর কিছু দরকার হলে আমি আছি।”
মাধুরী ধীরে ধীরে বলে,
“নন্দিনী, এটা কি ঠিক হবে? আমাদের সম্পর্ক তো এমনিই অনেক জটিল।”
নন্দিনী মুচকি হেসে বলে,
“জটিলতা মেটানোর জন্যই এই সমাধান। আর তোমার কোনো চিন্তা নেই। আমি সবকিছু সামলে নেব। শুধু তোমাদের হাসিমুখটা দেখতে চাই।”
বিয়ের দিন ঠিক হওয়ার পর নন্দিনী হঠাৎ একটি বিষয় নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে।
সে মাধুরী ও ইশানকে ডেকে বলে,
“ইশান, তোমার সব আইডি কার্ড আর নথিপত্রে মাধুরীর নাম মায়ের জায়গায় উল্লেখ করা আছে, তাই তো? তাহলে লিগ্যালি তোমাদের বিয়ে করা সম্ভব হবে না। এটা একটা বড় সমস্যা।”
ইশান অবাক হয়ে বলে,
“তুমি ঠিক বলছ, নন্দিনী। এটা তো আমার মাথায় আসেনি! কিন্তু এই সমস্যা কিভাবে সমাধান করব?”
মাধুরী গভীর চিন্তায় ডুবে বলেন,
“এই সমস্যার সমাধান করতে হলে আইনত আমার নাম সেই স্থান থেকে সরাতে হবে। কিন্তু সেটা সহজ কাজ নয়। অনেক নথি সংশোধন করতে হবে।”
নন্দিনী দৃঢ় স্বরে বলে,
“কিছুই অসম্ভব নয়। আমি আমার পরিচিত একজনের সঙ্গে কথা বলব। সম্ভবত একটি নথিপত্রের মাধ্যমে এই সংশোধন করা যাবে।”
পরদিন ইশান ও নন্দিনী একজন পরিচিত আইনজীবীর সঙ্গে দেখা করে। আইনজীবী বলেন,
“এটা একটু জটিল, তবে অসম্ভব নয়। মাধুরী যদি নিজের তরফ থেকে একটি হলফনামা দেন এবং ইশানের পিতামাতার নামের জায়গায় সংশোধনের আবেদন করেন, তাহলে এটা সম্ভব হতে পারে। তবে এতে কিছু সময় লাগবে।”
ইশান তৎক্ষণাৎ বলে,
“ যত সময় লাগুক আমরা অপেক্ষা করব। আমি চাই আমাদের সম্পর্ক লিগ্যাল এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হোক।”
কয়েক সপ্তাহের প্রক্রিয়ার পর ইশান তার সব নথিতে সংশোধন করতে সক্ষম হয়। নন্দিনী পুরো প্রক্রিয়া তদারকি করে এবং প্রতিটি পদক্ষেপে ইশান ও মাধুরীকে সাহস যোগায়।
ঈশান এবং মাধুরী বিয়ের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ঘরের পরিবেশ ছিল আনন্দমুখর, তবে কিছুটা শঙ্কিতও। মাধুরী ঈশানকে দেখে হাসলেন, "তুমি খুব উত্তেজিত মনে হচ্ছো।"
ঈশান হেসে বলল, "হ্যাঁ, আমি জানি, আজকের দিনটা আমাদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন।"
নন্দিনী এসে তাদের পাশে দাঁড়িয়ে বলল, "এটা নতুন শুরু, নতুন পথ। কিন্তু তোমাদের দুজনের ভালোবাসা আমি জানি, ওটা মধুর।"
ঈশান মাধুরীকে দিকে তাকিয়ে বলল, "আজ আমি জানি, তুমি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ।"
মাধুরী শান্ত স্বরে বললেন, "তোমার জন্য সবকিছু করেছি, ঈশান। আজ তোমার পাশে দাঁড়িয়ে এই নতুন যাত্রা শুরু করতে চাই।"
অবশেষে, বিয়ের সময় এসে পৌঁছল। মাধুরী এবং ঈশান একে অপরের দিকে তাকালেন। দুজনের চোখে ছিল এক অপরিসীম ভালোবাসা, তাদের চোখে এক নতুন অঙ্গীকার। মাধুরী ঈশানকে বললেন, "আমি তোমাকে জীবনভর ভালোবাসবো।"
ঈশান তার হাত ধরে বলল, "আমিও, মা। তুমি ছাড়া আমি কিছুই না।"
নন্দিনী পাশে দাঁড়িয়ে হাসলেন, "এটাই তো মা ছেলের প্রেম, যেখানে দুটি মানুষ একে অপরকে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ভালোবাসবে।"
বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হবার পর, মাধুরী এবং ঈশান একে অপরকে দেখলেন, সেই মুহূর্তে তাদের চোখে কোনো ভয়ের ছাপ ছিল না, বরং একটি শান্তি, বিশ্বাস এবং স্থিরতা ফুটে উঠেছিল।
নন্দিনী তাদের দিকে তাকিয়ে বলল, "এখন তোমরা একে অপরের জীবনের অঙ্গীকার হয়ে থাক। এই নতুন জীবন শুরু হওয়া যাক ভালোবাসা, স্নেহ এবং সম্মানের সঙ্গে।"
ঈশান মাধুরীর হাত ধরে বলল, "মা এটা শুধুমাত্র শুরু।"
মাধুরীও হেসে বললেন, "তাহলে শুরু হোক, ঈশান।"
বিয়ের পর, তিনজন একসাথে নিজেদের নতুন জীবন শুরু করল। তবে তারা জানত, ভালোবাসার জয় হবে, যতই বাধা আসুক না কেন।