পর্ব ৩২
"ডাক্তার-কাকু !" একসাথে বলে উঠল দীপা আর তিস্তা, তবে দীপার কণ্ঠে একটা আশ্চর্য সূচক শোনা গেলো | একে অপরকে চিনতে পেরে সবাই একে ওপরের দিকে অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো | সেই ঘন জঙ্গলের মাঝে সূর্য সবে অস্ত গেছে আর তার ফলে বাইরের দিকটা ঘুটঘুটে অন্ধকারে পরিণত হয়েছে |
" দীপা...তুমি...তোমরা...তোমরা এখানে..? কিন্তু...?" নীরবতা ভেঙে প্রশ্ন করে উঠলেন ডাক্তার-কাকু |
"হেল্প...আস, ডাক্তার-কাকু , প্লিজ....." তিস্তা তার দিকে তাকিয়ে কাতর ভাবে অনুরোধ করে উঠল
"হ্যাঁ নিশ্চয়ই...নিশ্চয়ই...ভেতরে এসো...ভেতরে এসো তোমরা " বলে দরজাটা হাট করে খুলে দিলেন ডাক্তার-কাকু | কোনও দ্বিধা ছাড়াই তিস্তা ভেতরে গটগট করে হেটে ঢুকে গেলেও দীপা নিজের মনের মধ্যে দ্বিধা অনুভব করল | ভেতরে যাওয়াটা কি ঠিক হবে? কিন্তু সে তো ডাক্তার-কাকুকে অনেকদিন চেনে ? তবে উনি এখানে কি করে...এই সব কথা নিজের মনে ভাবতে ভাবতে শেষমেশ দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকল সে | তবে সেই বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই আবার তাদের সেই দুর্ভেদ্য অন্ধকার ঘিরে ধরল |
"এই...তোমরা...তোমরা একটু দাড়াও...আমি লাইনটা ঠিক করে আসছি...." বলে সেই অন্ধকারের মধ্যে হারিয়ে গেলেন ডাক্তার-কাকু...
"লাইন? কি লাইন...?" দীপা ভয়ে জিজ্ঞেস করে উঠতেই সাথে সাথে ঘরের ভেতরের সব আলো জ্বলে গেলো |
বাইরে থেকে দেখে বাড়িটাকে কোনও হানাবাড়ি বলে মনে হলেও ভেতরে সেই আলো জ্বলে উঠতেই ওদের চোখ ধাঁদিয়ে গেল । বাড়ির প্রতিতা কনে কিছু না কিছু দামি জিনিস রাখাই ছিল । বাড়ির দেওয়ালে লাগান সব আসবাবপত্র আর মূর্তি থেকে একটা আভিজাত্তের আভা ঠিকরে বেড়িয়ে আসতে লাগল । আস্তে আস্তে ভেতরের ঘরে ঢুকতেই দূরে একপাশে রাখা একটা গ্র্যান্ড পিয়ানো দেখতে পেলো ওরা | অবাক হয়ে এইদিক ওইদিক তাকাতে ব্যস্ত হয়ে গেল ওরা, এমন সময় নিজেদের পেছনে দিক থেকে আবার তার কণ্ঠ ভেসে এলো
"এখানে....এখানে বস তোমরা, আমি জল নিয়ে আসছি" বলে তাদের কে সোফার দিকে ইশারা করলেন ডাক্তার-কাকু, তারপর পেছন দিকে ঘুরে আস্তে আস্তে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলেন |
"তুই...ডাক্তার-কাকুকে কি ভাবে চিনলি..? " তিশার দিকে তাকিয়ে তাকে প্রশ্ন করল দীপা | তিস্তার ওপর থেকে যে তার অনেকটাই বিশ্বাস চলে গেছে সেটা খুব ভালো করেই বুঝতে পারল রুদ্র , তবুও সেই বেবস অবস্থাতেই বসে তাদের মধ্যে কথোপকথন শুনতে লাগল |
"চিনলাম.." হালকা কণ্ঠে বলে উঠল তিস্তা
"কিন্তু কি করে...? কি করে তুই ডাক্তার-কাকু কে চিনলি তিস্তা..? বল আমায়...?" চেঁচিয়ে উঠল দীপা
"এই....দীপা, তুমি.....তুমি ওকে তিস্তা বলছ কেন? ওর নাম তো তিশা..." পাস থেকে আবার ডাক্তার-কাকুর কণ্ঠস্বর ভেসে এলো তার তাই শুনে সবাই সেই দিকে ঘুরতেই তাকে ঘরের ভেতরে ঢুকতে দেখল | তার হাতে একটা ট্রে আর তাতে চারটে জলের গ্লাস আর কিছু হালকা খাবার দাবার | আস্তে আস্তে সেগুলো তাদের সামনের টেবিলের ওপর রেখে সফার ওপর বসে পরলেন উনি ।
"নাহ....নাহ...ডাক্তার-কাকু.... এখন ওইটাই আমার নাম..." শান্ত গলায় বলে উঠল তিস্তা
"ওহ!! আচ্ছা আচ্ছা....বুঝেছি, বুঝেছি, পাণ্ডে-জি দিয়েছিলেন নাকি এই নামটা তোকে...?" হাসি হাসি মুখ করে বলে উঠলেন ডাক্তার-কাকু
"হ্যাঁ..." আস্তে করে বলে নিজের মাথা নামিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল তিস্তা
"আপনি...পাণ্ডে-জিকে....চিনতেন ডাক্তার-কাকু...?" অবাক হয়ে বলে উঠল দীপা | তার কাছে যেন সব কিছুই খবরের মতন মনে হতে লাগল |
"হ্যাঁ...চিনতাম...না, মানে চিনি তো । তাকে চিনবো না আবার,তবে...তবে কোথায় তিনি ?" বলে উৎসুক দৃষ্টিতে তিস্তার দিকে তাকালেন উনি |
সেই প্রশ্নের উত্তর ওদের সবাইকার জানা থাকলেও কেউ নিজের মুখ ফুটে সেটা বলতে চাইলো না | আচমকা ঘরের ভেতরটা প্রচণ্ড রকম নিস্তব্ধ আর গুমোট হয়ে গেল |
ওইদিকে নিজের প্রশ্নের প্রাপ্য উত্তর না পেয়ে ডাক্তার-কাকু আবার প্রশ্ন করে উঠলেন " কোই হে বন্ধুগণ...এরকম চুপ করে গেলে কেন তোমরা....?"
তবে তার কথা শেষ হতে না হতেই পাস থেকে রুদ্র বলে উঠল "নেই...পাণ্ডে-জি আর নেই...উনি মারা গেছেন..."
"কি...? মানে....? কি বলছ তুমি! " হালকা অস্ফুট স্বরে বলে উঠলেন উনি | তিনি যে এইরকম একটা খবর শুনবেন সেটার প্রত্যাশা তিনি একদমই করেননি, সেটা তার গলার আওয়াজ শুনে পরিষ্কার বোঝা গেল |
"কিন্তু....." বলে তিস্তার দিকে তাকালেন উনি | কিছুক্ষণ ওই ভাবে নীরব থাকার পর নিজের চোখের চশমাটা খুলে নিজের পাঞ্জাবির একটা কোন দিয়ে মুছে নিলেন...
"ঠিক....কিন্তু...তুমি কে ভাই ? ওদের...ওদের দুজনকে তো আমি ভালোভাবেই চিনতে পারছি, কিন্তু...কিন্তু তোমাকে তো চিনতে পারলাম না...তুমি কে? " চশমাটা আবার নিজের চোখে লাগিয়ে বলে উঠলেন ডাক্তার-কাকু, তারপর নিজের সাদা সাদা দুটো ভুরু কুঁচকে রুদ্রর মুখের দিকে তাকালেন |
"ওহ সরি..সরি, আমি রুদ্র...রুদ্র চ্যাটার্জী..."
সেই উত্তরটার শোনার জন্যও তিনি প্রস্তুত ছিলেন না । "তুমি, তুমি....রুদ্র???" চেঁচিয়ে উঠে বড়ো বড়ো চোখ করে তাকালেন রুদ্রর দিকে তারপর হঠাৎ তিস্তার দিকে ফিরলেন ডাক্তার-কাকু | তিস্তা দিকে তাকাতেই তার মুখে একটা হালকা হাসির রেখা দেখতে পেলেন উনি |
"হ্যাঁ, রুদ্র...কেন...? কি হয়েছে..?" রুদ্র পাল্টা প্রশ্ন করে উঠল
"না..কিচ্ছু হয়নি..." বলে নিজের জায়গা থেকে উঠে পড়লেন ডাক্তার-কাকু, তারপর টেবিলের ওপর থেকে সেই ট্রেটা তুলে সবার দিকে বারালেন । সারাদিনের সেই ক্লনাতির পর তিনজনেরই খুবই খিদে পেয়েছিল তাই দ্বিতিওবার অনুরধ করার আগেই গবগব করে প্লেটের ওপর থাকা খাবার এক নিশ্বাসে খেয়ে ফেলল ওরা।
ওদের খাওয়া শেষ হতেই নিজের হাতে ট্রেটা তুলে নিলেন ডাক্তার-কাকু , তারপর বলে উঠলেন , " তোমাদের অবস্থা দেখে.... খুব একটা ভালো মনে হচ্ছেনা আমার....যাও যাও...তোমরা একে একে বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও...আমি ততক্ষণ রাতের খাবারের দিকটা দেখি...." বলে একটু এগোতেই আবার পেছন ফিরে তাদের দিকে তাকালেন উনি, " আররর...এখানে সব সময় পাওয়ার আর জল থাকে....তাই কোনও কিছুতে লজ্জা বোধ করো না তোমরা..."
"দাঁড়ান...দাঁড়ান ডাক্তার-কাকু আমিও যাচ্ছি আপনার সাথে..." ওনাকে থামিয়ে দীপা বলে উঠল |
"যাবে ? চলো তাহলে..." বলে দুজনে একসঙ্গে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল
"আমি বাথরুমে যাচ্ছি..." বলে রুদ্রও নিজের জায়গা থেকে উঠে তিস্তাকে ওখানে একা রেখে বাথরুমের উদ্দেশে চলে গেল |
"ডাক্তার-কাকু, আপনি এখানে ? এখানে কি করে...কি করে এলেন? " রান্নাঘরের মধ্যে ঢুকতেই দীপা তাকে প্রশ্ন করে উঠল | দীপার যে আর তস সইছিল না সেটা তার মুখ দেখে বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছিলেন ডাক্তার-কাকু ....
"দীপা...তুই...সবই তো জানিস মা, কি অবস্থা হয়েছিল আমাদের তখন...কত নিরীহ মানুষকে মরতে হয়েছিল সেই সময়ে..." উদাসীন কণ্ঠে বলে উঠলেন ডাক্তার-কাকু
"জানি, জানি ডাক্তার-কাকু...কিন্তু আপনি এখানে...একাই..? অন্যরা কোথায়...? মানে মানুদা, ওসি ওরা...ওরা...ওরা কোথায়....? "
"ওরা কেউই আর বেঁচে নেই দীপা....সেইদিন...সেইদিনই, ওরা সবাই আমাদের ছেড়ে চলে গেছে..." দরজার পাস থেকে একটা টুল বের করে ধপ করে ওর ওপর বসে পড়লেন উনি....."আমরাও হয়ত বাঁচতাম না তবে....ইনফার্মারী..বলে আমাদেরকে নিস্তার দিয়েছিল ওরা.....কিন্তু এইচ...এইচ কিউয়ের প্রত্যেকটা মানুষকে, ওরা শেষ করে দিয়েছিল...শেষ করে দিয়েছিল দীপা...." বলতে বলতে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন ডাক্তার-কাকু । বছরের পর বছর জমে থাকা সেই কথা গুল তার স্রিতিতে নারা দিয়ে উঠল ।
দীপা সেই দেখা দেখি ডাক্তার-কাকুর সামনে বসে তাকে জড়িয়ে ধরল " আমি...আমি আর ওই...ওই সব কিছু বরদাস্ত করতে পারিনি রে মা....তাই...তাই এইখানে...এইখানে এসে গা ঢাকা...দিয়ে ছিলাম...." কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠলেন ডাক্তার কাকু ," আমি খুব ভীতু....আমি খুব স্বার্থপর..রে দীপা...."
"না...না ডাক্তার-কাকু, আপনি স্বার্থপর কোনোদিন ছিলেনও না আর হবেনও না....আর নিজেকে আপনি ভীতু কি করে বলছেন...? আপনি না থাকলে সেই হাজার হাজার প্রাণ কি করে বাঁচত...কি করে আমি...." বলতে বলতে থেমে গেল দীপা, তারপর আস্তে আস্তে মেঝে থেকে উঠে বলল "তাহলে...তাহলে তখন থেকে আপনি এখানে একই থাকেন....মানে..?"
"হ্যাঁ...রে আর যতদিন বেঁচে থাকবো এখানেই নিজের মাথা গুঁজে রাখবো, তবে..তবে আর হয়তো বেশিদিন নেই.....মনে হয় | জানিস তো এখন মা....মাঝে মাঝেই....দূর থেকে.... একটা আলোর মতন কিছু একটা দেখতে পাই আর মনে হয় যেন আমাকে সেখানে যাওয়ার জন্য কেউ ডাকছে।সেইখানেই...হয়তো একদিন টেনে নিয়ে যাবে আমায়..." শান্ত গলায় বলে উঠল ডাক্তার-কাকু
"না...না ওরকম কথা বলবেন না ডাক্তার-কাকু...এতদিন পর আমরা সবাই আমাদের আপন একজন কে পেয়েছি আর তার মধ্যে আপনি এইরকম কথা...কি করে বলছেন? এখনও অনেক, অনেকদিন বাঁচতে হবে আপনাকে...." দৃঢ় কণ্ঠে বলে উঠল দীপা
"আরও অনেকদিন? ঠিক...তাই...তাই হবে...." বলে নিজের চোখের জল নিজের হাত দিয়ে মুছে ফেললেন ডাক্তার-কাকু ," তবে...তোরা এখানে হঠাৎ কেন...মানে এতদিন কোথায় ছিলি তোরা মা...?"
"কলকাতায়" ঠাণ্ডা গলায় বলে উঠল দীপা তারপর , "তবে....ডাক্তার-কাকু, এখানে এসে আমার মনে একটা প্রশ্ন জেগেছে আজকে....না শুধু আজকেই নয় অনেকদিন ধরেই সেটা জেগেছে তবে আজকে সেটা....." তবে নিজের কথা শেষ করার আগেই ডাক্তার - কাকু বলে উঠলেন
"কি প্রশ্ন? কি প্রশ্ন দীপা মা...? নির্দ্বিধায় বলে ফেল..সেটা"
"না মানে... প্রশ্নটা তিস্তাকে নিয়ে মানে ওই তিশা...যাই হোক ওর নাম...ওকে আমি আর ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিনা ডাক্তার-কাকু...মানে ওর হাব ভাব ওর সব ডিসিসান মাকিন আমার একদমই ভালো ঠেকছে না....আমাদের থেকে ও কিছু লুকছে কাকু...." দীপা বলে উঠল
"অ্যাই এম সরি টু টেল ইয়উ দিস দেপা বাট তোর এই ধারণাটা পুরোটাই একদম ভুল" দীপার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন ডাক্তার-কাকু ।
"ভুল ? ভুল কেন ? তবে আপনি ওকে কি করে চিনলেন? মানে ও পেসেন্ট ছিল নাকি আপনার? কিন্তু এই বাড়ির ব্যাপারে ও কি করে জানল...? " একটার পর একটা প্রশ্ন করে যেতে লাগল দীপা
"তাহলে...তুই শুনতে চাস...তাইতো...? ঠিক আছে...." বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন ডাক্তার-কাকু তারপর, " তোরা যে সেইদিনের পর ঠিকই থাকবি সেটা আমি জানতাম আর আমিও ভাবছিলাম তোদের নিয়ে এখানে চলে আসতে....কিন্তু..কিন্তু...সেই বড়ো বোমটা ডেটোনেট হওয়ার পর আমি আর তোদের বাঁচার আসা ছেড়ে দিয়েছিলাম রে মা....যদি জানতাম যে তোরা ঠিক আছিস তাহলে নিশ্চয়ই তোদের খুঁজে বার করে আমার এই এইখানে নিয়ে আসতাম.....আর নিয়ে এসে..." বলতে বলতে থেমে গেলেন গেলেন ডাক্তার-কাকু
"নিয়ে এসে কি? কি ডাক্তার-কাকু....?" জিজ্ঞাসু কণ্ঠে বলে উঠল দীপা
"নিয়ে এসে তার সঙ্গে তোদের দেখা করাতাম....তবে...তবে তোর সেইদিন কার কথা মনে আছে মা ? মনে আছে সেইদিন...যেদিন তোর রুদ্রকে প্রথমবারের জন্য খুঁজে পেয়েছিলি তুই...? সেইদিন....?" বলতে বলতে ডাক্তার-কাকুর চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠল ।
"ডাক্তার-কাকু আমি যাই ভুলে যাই না কেন...সেইদিনটার কথা আমি কোনোদিনও ভু......আপনি না থাকলে...আমার রুদ্র" বলে থেমে গেল দীপা তারপর চকিতেই আবার বলে উঠল, " কিন্তু...কিন্তু সেটার..সেটার সাথে আমার এই প্রশ্নের কি সম্পর্ক....কি সম্পর্ক ডাক্তার-কাকু" অধৈর্য হয়ে বলে উঠল দীপা | তিস্তার আসল পরিচয় আর ওর উদ্দেশ্য জানার জন্য তার মন যে কতটা আনচান করছিল সেটা ডাক্তার-কাকু বুঝতে পারলেন আর বুঝতে পেরে সোজাসুজি আসল পয়েন্ট গেলেন ।
"পুরোটাই....পুরোটাই দীপা" বলে নিজের টুল থেকে উঠে পড়লেন ডাক্তার-কাকু, তারপর আস্তে আস্তে ফিল্টারের সামনে গিয়ে একটা ডেকচিতে জল ভরলেন, তারপর দীপার দিকে ঘুরলেন, " তোর সেই মেয়েটার কথা মনে আছে....সেই মেয়েটা, যাকে আমরা রুদ্রর সাথে খুঁজে পেয়েছিলাম ...মনে আছে সেই কাটা ছেঁড়া অবস্থায় পরে থাকা সেই ছোট মেয়েটাকে.....?" দীপার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন ডাক্তার- কাকু
"হ্যাঁ...হ্যাঁ ডাক্তার-কাকু ওকে, ওকে কি করে ভুলতে পারি আমি....ওই মেয়েটাই তো রুদ্রকে সব কিছুর থেকে বাঁচিয়ে তোমাদের কাছে নিয়ে আসছিল....কিন্তু...."
"কোনও কিন্তু নয় দীপা.....ওই মেয়ে....ওই মেয়েটাই তিশা....দীপা, তোদের তিস্তা..." চেঁচিয়ে উঠলেন ডাক্তার-কাকু আর সেই কথা দীপার কানে পৌঁছতেই দীপার শরীর মন সব কিছুই একদম তোলপাড় হয়ে গেল | কি কি বললেন ডাক্তার -কাকু....আমার রুদ্রকে...তিস্তা...তিশা.....দীপার মাথা সাথে সাথে তালগোল পাকিয়ে যেতে লাগল আর মাথা ঘুরে প্রায় পরে যেতেই ডাক্তার-কাকু তকে ধরে নিলো | যে মেয়েটার ওপর সে সন্দেহ করছিলো সেই মেয়েটাই তার রুদ্রকে সেইদিন বাঁচিয়ে ছিল, না...শুধু সেইদিন নয়, আজকেও | রুদ্রকে যদি ও সেদিন না নিয়ে আসত তাহলে...তাহলে হয়তো সে তার রুদ্রকে কোনোদিনও ফিরে পেত না |
তবে সেই জন্যেই প্রথম দেখাতেই একবারে চিনে গেছিল রুদ্রকে....চিনে গেছিল তার সেই একদিনের বন্ধুকে । সেই সেই প্রথমদিন থেকেই সব বিপদের হাত থেকে রুদ্রকে বাঁচিয়ে যাচ্ছে মেয়েটা আর সে কিনা টার ওপর সন্দেহ করছে....... এতসব চিন্তা ভাবনা নিজের মনে ফুটে উঠতেই নিজের কপালে ভীষণ যন্ত্রণা অনুভব করল দীপা...তার মনে হল এখুনি বুঝি তার কপালটা ফেটে যাবে রক্ত বেরিয়ে যাবে | টুলর ওপর বসে নিজের মাথাটা দুহাত দিয়ে চেপে ধরে জোরে চেঁচিয়ে উঠল |
"এ আমাকে কি বললেন ডাক্তার-কাকু...আমার...আমি" দীপার মুখ থেকে অসংলগ্ন কথাবাত্রা শুনে ডাক্তার - কাকু তার দিকে এগিয়ে এলেন
"কাম ডাউন দীপা, কাম ডাউন....এইনে...এইনে...হ্যাভ সাম ওয়াটার" বলে দীপার হাতে একটা জলের গ্লাস ধড়িয়ে দিলেন, তারপর রান্নাঘরের ওপরের ড্রয়ার থেকে একটা সাদা রঙের বাক্স বার করলেন ,"তোর এখন কত বয়স হল যেন...এক্তিরিশ...তাই না?" বলে সেই সাদা বাক্স থেকে ট্যাবলেটের একটা পাতা বার করে একটা ট্যাবলেট বের করে দীপার হাতে ধরিয়ে দিলেন " খেয়ে...নে, খেয়ে নে ওটা...মাথা ব্যথার....."
নিজের হাতে থাকা গ্লাস থেকে মুখে এক ঢোঁক জল নিয়ে ওষুধটা খেয়ে নিলো দীপা | কিছুক্ষণ ওইরকম টুলের ওপর বসে থাকার পর শেষমেশ উঠে নিজের হাতের গ্লাসটা রান্নাঘরের কাউন্টারের ওপর রাখল ।
" কিন্তু...কিন্তু ডাক্তার-কাকু....তাহলে এতদিন..এতদিন ও কোথায় ছিল? মানে...মানে পাণ্ডে-জির কাছে তো ছিলই সেটা জানি....কিন্তু তার..তার আগে কোথায় ছিল ও?" ডাক্তার-কাকুর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে উঠল দীপা
"একটা খুব খারাপ জায়গায় দীপা...খুবই খারাপ জায়গায় " ডাক্তার-কাকু বলে উঠলেন
সাওয়ারের ঠাণ্ডা জলের নিচে দাঁড়িয়ে নিজের শরীর সব ক্লান্তি ও গ্লানি ধুতে ধুতে রুদ্র অনুভব করল কে যেন তাকে পেছন দিক থেকে জড়িয়ে ধরল | রুদ্রর হাতের নিচ দিয়ে নিজের হাত দুটো ঢুকিয়ে দিয়ে রুদ্রর শরীরের সাথে নিজের শরীর চেপে ধরল তিস্তা | তার নরম শরীরের স্পর্শ পেয়ে আপনা থেকে চোখ বন্ধ হয়ে গেল রুদ্রর |
"আজকে....আবার তুম...তুমি আমাকে বাঁচালে" বলে আস্তে আস্তে তিস্তার দিকে ঘুরল রুদ্র | তিস্তার শরীরের স্পর্শ পেয়ে সেটা বুঝলেও এইবার সামনা সামনি আসতেই তিস্তাকে নিজের মতনই নগ্ন অবস্থায় দেখল রুদ্র | তিস্তার দিকে আরও একটু এগিয়ে গিয়ে ওকে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরল রুদ্র | তার মনে হতে লাগল যেন সে তিস্তাকে অনেকদিন, অনেককাল ধরে চেনে, সে খুবই আপন কেউ তার | সেই ঠাণ্ডা জলের ঝর্ণার নিচে রুদ্রর নগ্ন শরীরের উষ্ণতা নিজের শরীরে অনুভব করতেই তাকে আরও জোরে জড়িয়ে ধরল তিস্তা আর সেটা করতেই রুদ্র ব্যথায় কোকীয়ে উঠল |
"কি...হল? লাগল ? লাগল তোমার...? " বলে সাথে সাথে রুদ্রকে ছেড়ে দিয়ে নিজের প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ওর মুখের দিকে তাকাল তিস্তা ।
"না..না লাগেনি, লাগেনি...ওসব কিছু না...কিছু হয়নি" বলে তাকে আবার জড়িয়ে ধরতে যেতেই রুদ্রকে বাধা দিলো তিস্তা । তিস্তা ঠিকি বুঝেছিল যে রুদ্রর লেগেছে তাই আস্তে আস্তে নিজের মাথাটা নিচু করে রুদ্রর পেটের ওপর দিকটায় তাকাতেই ও থমকে দাঁড়াল | আস্তে আস্তে আরও একটু সামনে এগিয়ে আসতেই দেখল যে তার পেটের ওপর দিকে অনেকটা অংশ নিয়ে রক্ত জমে কালশিটে পরে গেছে |
"এ...এখানে...এখানে খুব ব্যথা, তাই না..? " বলে আস্তে আস্তে নিজের হাত দিয়ে সেই জখম জায়গাটার ওপর বোলাতে লাগল তিস্তা | তার স্পর্শে রুদ্রর নিজের শরীরটাকে তৃপ্তিতে ভোরে যেতে অনুভব করল আর আস্তে আস্তে সেও নিজের হাতে করে তিস্তার মুখটা নিজের মুখের সামনে তুলে ধরে ওর ঠোঁটে চুমু খেলো রুদ্র | আর সেই চুম্বন ছিল পৃথিবীর সব থেকে লম্বা চুম্বন, তবে তাতে না ছিল কোনও কামনা না ছিল কোনও বাসনা | শুধু ছিল ভালোবাসা আর ভালোবাসা | সেই প্রেমের মুহূর্তে, ঠাণ্ডা জলে ভিজতে ভিজতে নিজেদের শরীরের উষ্ণতা অনুভব করে একে অপরের মধ্যে সব দূরত্ব ঘুচিয়ে ফেলতে লাগলো ওরা | ওদের মনে হল যেন সেই পৃথিবী থেমে গেছে, শুধু জেগে রয়েছে তারা । অনেকক্ষণ ধরে সেই গভীর চুম্বন উপভোগ করার পর আস্তে আস্তে তিস্তার ঠোঁটের ওপর থেকে নিজের ঠোঁট সরিয়ে নিলো রুদ্র, তারপর তিস্তার চোখে নিজের চোখ রেখে প্রশ্ন করে উঠল :
"তিস্তা...ওই গুণ্ডাটা তোমাকে...চিনতো? তাই না..?"
"হ্যাঁ...হ্যাঁ রুদ্র, আর আমিও ওকে চিনতাম । ওর নাম রনজু " বলতে বলতেই তিস্তার চোয়াল দুটো শক্ত হয়ে যেতে লক্ষ্য করল রুদ্র |
" হম....কিন্তু তোমার...তোমার সাথে ও কিসের বোঝা পড়ার কথা বলছিল তিস্তা, কি বদলা...কি চাইছিল তোমার কাছ থেকে...? " রুদ্র প্রশ্ন করে উঠল
"তুমি...জানতে চাও...? কিন্তু আমার...." উদাসীন কণ্ঠে বলে উঠল তিস্তা
"তিস্তা...এইদিকে তাকাও..." বলে তিস্তার চিবুকে নিজের হাতে করে ওপর তুলে ধরল রুদ্রও, "তোমাকে আমি কখনোই কষ্ট দিতে চাইনা....আর এই ব্যাপারটা আমায় বলতে যদি তোমার কষ্ট লাগে...তাহলে আমার সে সব ব্যাপারে জানার কোনও ইচ্ছা নেই...." বলে আবার তিস্তাকে জড়িয়ে ধরল রুদ্র
"না...রু, আজকে..তোমাকে সব কিছুই বলবো আমি.." বলে আস্তে আস্তে সামনের দিকে এগিয়ে সাওয়ারের নবটা ঘুরিয়ে বন্ধ করে দিলো তিস্তা, তারপর আস্তে আস্তে সেই ভেজা মেঝের ওপর বসে রুদ্রর হাত ধরে ওকেই নিচে তার বসতে বলল | প্রথমে একটু অবাক হলেও, পরোক্ষনে তিস্তার মনের কথাটা বুঝতে পেরে মেঝেতে বসে পড়লো রুদ্র | তিস্তাকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে হাত দিয়ে ওর কোমর জড়িয়ে ধরল রুদ্র । তিস্তাও সেই পরম তৃপ্তি পেয়ে রুদ্রর কাঁধে নিজের মাথা এলিয়ে দিল |
"বলও এবার...আমি প্রস্তুত....."
"রুদ্র....তুমি এখন আমায় যে অবস্থাতে দেখছ, আগে সেরকম আমি একদমই ছিলাম না | ভদ্রসমাজে আমারদের মতন মানুষের কোনও জায়গা ছিল না জানো... কারণ আমার জন্ম হয়েছিল একটা নিষিদ্ধ-পল্লীতে, নিষিদ্ধ-পল্লি নিশ্চয়ই বঝো তুমি...?" তার প্রশ্ন শুনে রুদ্র নিজের আস্তে করে নিজের মাথা নাড়াতেই তিস্তা আবার বলতে আরম্ভ করলো ।
"ছোটবেলা থেকেই...আমার মতন বাচ্চাদের একটাই পরিচয় হয় রুদ্র ; আমরা সব বেশ্যার বাচ্চা..." বলে নিজের মাথা নিচু করে নিলো তিস্তা ,"আমি আমার বাবাকে কোনোদিনও দেখিনি জানতো, তবে আমার...আমার মা আমাকে খুব ভালোবাসত...| রাতের পর রাত খেটে যা কিছু আয় করতো তাই দিয়েই আমাকে খুশিতে আনন্দে রাখার চেষ্টা করতো জানো তো...আর সেই দেখে পাশের সব কাকিমারা মাকে নিয়ে মজা করত, বলত রেন্দির বাচ্চা আবার খুশিতে থাকবে...... সেই সব বলে...সেই সব নিয়ে ঠাট্ট করলেও মা কোনোদিন তাতে কান দেয়নি....কিন্তু যখন একটু বড়ো হলাম আর বুঝতে শিখলাম তখন রোজরোজ মায়ের ওই অবস্থা দেখে আর সহ্য করতে পারতাম না আমি...রুদ্র | ছোট হলেও মনে হত যেন কি একটা...কি একটা জিনিস জোর করে ছিনিয়ে নিচ্ছে ওরা মায়ের কাছ থেকে | এইভাবেই দিনের পর দিন রাতের পর রাত কেটে যেতে লাগলো...তবে আমাদের যা ছিল সেটা ছিল খুব অল্পই কিন্তু সেই অল্পতেই আমরা খুব খুশি ছিলাম । তবে......বেশিদিন সেই সুখ সইল না আমার কপালে রুদ্র...এমন একটা অসুখ করল মায়ের যেটা সারাবার মতন কেউই নেই এই পৃথিবীতে ছিল না, তাই...তাই মাও আমাকে ছেড়ে একদিন চলে গেল রুদ্র..." নিজের কথা শেষ করে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ল তিস্তা |
"তবে..তবে সেটাতে একটা ভালো জিনিসও হল জানতো...ডাক্তার-কাকুর সঙ্গে আমার আলাপ । মানে ডাক্তার-কাকু আমাকে সেই ছোট্ট বেলা থেকেই চিনতেন...মাঝেমাঝে আসতেনও আমাদের বাড়িতে, আমার জন্য ভালোমন্দ খেলনা নিয়ে আর তাই মায়ের সেই খবর শোনার পর উনি আমায় নিজের সাথে নিজের ক্লিনিকে নিয়ে এলেন । আর তারপর থেকে সেই ডাক্তার- কাকুর ক্লিনিকেই থাকতে আরম্ভ করলাম আমি....কিন্তু ওই...তোমায় বললাম না সুখ আমার কপালে বেশি দিন সয়না ...."বলে মাথা ঘুরিয়ে রুদ্রর দিকে তাকাল তিস্তা
"কেন? কি হয়েছিল তারপর ?"
"যুদ্ধ রুদ্র....সেই যুদ্ধ" বলতেই রুদ্রর চোখের সামনে সেই স্মৃতি ভেসে উঠল
"জানো তো রুদ্র ডাক্তার-কাকুর ক্লিনিকে থাকা কালীন আমার মনে হত যেন আবার সব কিছু আগের মত ঠিক ঠাক হয়ে গেছে । আমারও অনেক স্বপ্ন ছিল রুদ্র...সেই স্বপ্ন যেগুলো আর পাঁচটা সাধারণ ছেলে মেয়েদের থাকে, অনেক, অনেক কিছু করার ইচ্ছা ছিল আমার, কিন্তু....কিন্তু ওই শালার যুদ্ধটা আবার সব কিছু কেড়ে নিয়েছিল আমার থেকে, সব কিছু....." বলে নিজের চোখের জল মুছল তিস্তা |
"কিন্তু ওই যুদ্ধতেই....পেলাম এমন একটা জিনিস, না...জিনিস নয়, এমন একজনকে...কিন্তু তাকে পেয়েও আবার তাকে হারিয়ে ফেললাম আমি রুদ্র......তবে নিয়তির খেলা দেখো..পরে আবার আমার জীবনের সাথে জড়িয়ে পড়লো সেই বেক্তি" বলে রুদ্রর মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল তিস্তা | সেই ব্যাপারে অবগত থাকার কারণে রুদ্র তার কথার কোনও কূলকিনারা করতে না পেরে নিজের ভুরু দুটোকে কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে দিলো দিয়ে বলে উঠল ঃ
"তারপর, তারপর কি হল তিস্তা...?"
"তারপর কি হল...? তারপর শুরু হল আমার জীবনের সব থেকে খারাপ সময়ের | আর সেই খারাপ সময়টা ছিল রনজু " ঠাণ্ডা গলায় বলে উঠল তিস্তা
"রনজু? রনজু মানে.....আজকে যাকে তুমি....." বলতে বলতে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল রুদ্র
"হ্যাঁ...ওই শূয়রের বাচ্চাটাই..." নিজের দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বলে উঠল তিস্তা ," তবে যুদ্ধ নিজের মতন শুরু হয়ে নিজের মতন শেষ হয়ে গেলেও যাদের হারাবার তাদের সব কিছুই হারিয়ে গেছিল, রুদ্র | আমিও সেই সময় ডাক্তার-কাকুকে হারিয়ে ফেললাম আর তার সাথে সাথে হারিয়ে ফেললাম আমার বাঁচার আশাটাকে | কি ভাবে যে তখন কাটিয়েছি সেইসব দিনের কথা এখনও মনে পরলে এখনও আমার বুকটা ভয়ে ঠাণ্ডা হয়ে যায় রুদ্র | কি করেই না রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতাম আমি...ভিক্ষে করতাম একটু কিছু খেতে পাওয়ার জন্য...যদি কেউ একটু কিছু খেতে দিতো সেখানেই থেকে যেতাম আমি....." বলে কিছুক্ষণের জন্য থামল তিস্তা, তারপর আবার বলে উঠল ;
"সেইরকমই একদিন...খাবারের লোভ দেখিয়ে আমাকে ধরে কলকাতা থেকে এখানে লরি করে পাচার করে দিলো কেউ একজন"
"এখানে...এখানে মানে...ধানবাদে...?"
"হ্যাঁ রুদ্র ধানবাদে...আর এখানে আমার স্থান হল এখন কার মহিলা পল্লীতে, তবে তুমি চিন্তাও করতে পারবেনা সেটা আমার জন্য কতটা খারাপ পরিণতি ডেকে আনল | ছোট ছিলাম তো তাই আমাদের ওপরে কেউ কোনও সন্দেহ করতো না, তাই আমাকে আর আমার বন্ধুদের দিয়ে সব রকমের জিনিস এইদিক থেকে ঐদিক হেরাফেরি করাত ওরা | সব রকমের জিনিস বলতে তুমি বুঝতেই পারছ ; ড্রাগস, মদ, টাকাপয়সা, অস্ত্রশস্ত্র...সব কিছুই। তবে কি জানো তো...মহিলা পল্লীতে থাকার কারণে আমরা মেয়েরা অনেকটাই সুরক্ষিত ছিলাম, অনেক ভালো ছিলাম কিন্তু আস্তে আস্তে আমার বয়স বাড়তেই ওদের চোখ পড়লো আমার শরীরের ওপরে পড়ল | মহিলা পল্লী হওয়ার কারণে সেখানে শুধু মেয়েরাই থাকত আর এমন কেউই ছিল না যে জরজবরদস্তি করে সেই ধান্দায় আমাদের নামাতে পারত "
"মানে..তুমি না চাইলে..."
"হ্যাঁ..আমি না চাইলে আমাকে জোর করে কেউ সেই ব্যবসায়ে নামাতে বাধ্য করতে পারতো না...কিন্তু তক্ষণই আমার জীবনে রনজু আর ওর দাদা নিলয়ের আগমন হল | আমাকে জরজবরদস্তি করতে পারবেনা জেনেও আমাকে সেই ধান্দায় নামার জন্য বাধ্য করতে চেষ্টা করতে লাগলো ওরা | রোজ রাতে সবাই শুয়ে পড়লে রনজু আর ওর দাদা এসে আমাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে, আমার মুখে কাপড় বেঁধে...আমায়...আমায় চাবুক দিয়ে মারত রুদ্র...." বলে আস্তে করে সামনের দিকে এগিয়ে এসে রুদ্রর দিকে নিজের পিটটা ঘোরাতেই, রুদ্র দেখল যে তাতে এখনো কিছু দাগ উঁচু উঁচু হয়ে রয়েছে | নিজের হাত দিয়ে তিস্তার সেই পিঠের দাগের ওপর বোলাতে বোলাতে সেই অন্যায়ের কথা চিন্তা করে রুদ্রর রক্ত রগে ফুটতে লাগলো ।
"আর...আর বলতে হবেনা তোমাকে তিস্তা...আমি আর তোমার পুরনো স্মৃতি জাগিয়ে তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনা...." রুদ্র বলে উঠল
"না রুদ্র....প্লিজ..আজকে আমাকে বলতে দাও" বলে রুদ্রর হাতটা চেপে ধরল তিস্তা, "আমায় ওরা দেহ ব্যবসায়ে নামানোর চেষ্টা করলেও সেটা কোনোদিনই করতে পারেনা ওরা | তবে রোজ রাতে রনজু আর ওর দাদার আমার জেদ ভাঙবার জন্য সেই একইভাবে আমাকে চাবুক দিয়ে মেরে যেতে লাগল...তবে ওরা চলে গেলেও আমি ঠিক করে ঘুমতে পারতাম না রুদ্র...জানো তো...তবে যদিও ঘুমিয়ে পরতাম সকালে উঠে দেখতাম যে বিছানাতে রক্ত লেগে রয়েছে । সেই ক্ষতর উপর রজ নতুন ক্ষত হয়ে সব শেষ হয়ে যেতে শুরু করেছিল রুদ্র...... |"
"কিন্তু সেইদিন...সেইদিন আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছিলো " বলতেই তিস্তার চোখে সকালের সেই বিধ্বংসী আগুন জ্বলে উঠতে দেখল রুদ্র |
"তখন বর্ষা কাল...সবেমাত্র রাতের খাওয়া সেরে নিজের বিছানাতে শুয়েছি এমন সময় অনুভব করলাম কে যেন আমার গলা টিপে ধরল আর সাথে সাথে নিজের শরীরে ওপর ভারী কাউকে উঠতে অনুভব করলাম আমি | সাথে সাথে নিজের চোখ খুলতেই রনজুর দাদা নিলয়কে দেখলাম আমি...তবে..তবে সেদিককার তার রূপ যেন আগের চেও বীভৎস | আস্তে আস্তে আমার পরনের কাপড়ে হাত দিতে যেতেই বিছানায় পরে থাকা পেনটা ওর চোখ ঢুকিয়ে ওর চোখটা গেলে দিলাম | সেই ব্যথা সহ্য করতে না পেরে নিলয় ছিটকে বিছানা থেকে পরে গেল আর মেঝেতে পরতেই সামনে যা পেয়েছিলাম, তাই দিয়েই মারলাম ওকে । খাটের নিচে মাছ কাটার বঁটিটা ছিল আর সেইটা নিজের হাতে তুলে নিয়ে সোজা ওর বুকের ওপর বসিয়ে পেট বরাবর চালিয়ে চিরে দিয়েছিলাম আমি...." বলে থামল তিস্তা
রুদ্র অবাক হয়ে এক মন দিয়ে তিস্তার কথা শুনছিল আর মাঝে মধ্যে নিজের হাত দিয়ে ওকে আঁকড়ে ধরছিল ।
"সেখান বেরিয়ে বৃষ্টির মধ্যে দৌড়োতে দৌড়োতে কতদূর এসেছিলাম, সেটা আমি জানি না তবে ভাগ্যক্রমে বা কো ইন্সিডেন্টালি সেইদিন আবার ডাক্তার-কাকুর সঙ্গে শহরের বাজারে দেখা হল আমার...উনি আমার কাছ সব কিছু শুনে বুঝেছিলেন যে এখানে...এই বাড়িতে আমাকে রাখা ঠিক হবেনা...মানে আমার সেফটির জন্য আর ঠিক তখনই ওই অবস্থাতে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন পাণ্ডে-জি " নিজের কথা বলা শেষ করে রুদ্রর দিকে তাকাল তিস্তা ।
"তবে একটা জিনিস তিস্তা...ও কেন বলল যে ও তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলো মানে ও কি করে জানল যে তুমি ওইখানেই আবার ফিরবে ?"
"কারণ রুদ্র, সেলেব্রেশন হোটেলের সেই ঘরেই আমি প্রথমবার পাণ্ডে-জিকে দেখেছিলাম..."
"মানে...? কোন রুম...? ওই সেকেন্ড ফ্লোর রুম ৯....?" অবাক হয়ে প্রশ্ন করল রুদ্র
"হ্যাঁ...আর ওইখান থেকে পাণ্ডে-জি আমাকে নিতে এসেছিলেন, সবই ডাক্তার-কাকুর কথায়...তবে রনজু সে ব্যাপারে জানতে পারলেও পাণ্ডে-জির ভয়ে আমায় কিছু করতে আর সাহস পায়নি..."
"কিন্তু..কালকে যে তুমি বললে তুমি কোনোদিন সেখানে যাওনি...?"
"যাইনি তো...আমি গেছিলাম যখন সেটা সেলেব্রেশন হোটেল ছিল..এখন তো সেটা একটা গেস্ট-হাউস, তাইনা...?" বলে ফিক করে হেসে ফেলল তিস্তা, " তবে জানো তো রুদ্র...যে ঘরের দোরগোড়া থেকে আমি আমার মুক্তির পৃথিবীতে পা রেখেছিলাম সেটাকে আমি কোনোদিনও ভুলতে পারব না..."
"হমমম....তবে তুমি এখন পুরোপুরি মুক্ত, বল..?" রুদ্র নিজের মাথা ঘুরে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল
"হ্যাঁ...আপাতত, আপাতত আমি মুক্ত...তোমায় এইসব কথা জানাবার জন্য" শান্ত গলায় বলে উঠল তিস্তা
'কিন্তু আমার সেটা মনে হয়না..জানো তো" বলেই তিস্তার কোমরটাকে নিজের হাতে করে জড়িয়ে ধরে তিস্তাকে নিজের কোলের ওপর তুলে নিলো রুদ্র
"এই..এই..এই. কি করছ ? " অদূরে গলায় বলে উঠল তিস্তা | নিজের জীবনের সব খারাপ, কালো মুহূর্তগুল শোনার পরেও তার ভালোবাসার মানুষ তাকে কাছে টেনে নিচ্ছে, এর থেকে বড়ো পাওয়া আর হয়তো কিছুই তিস্তার কাছে তাই সেও রুদ্রকে চেপে ধরল ।
"কি করছে এটা বুঝতে পারছনা...? আদর...আদর করছি তোমায় " বলে তিস্তার ঘাড়ে চুমু খেতে খেতে আলতো করে ওর কানের লতিতে
কামড়ে ধরল রুদ্র
"আঃহ্হ্হঃ...ইস্স্স" রুদ্রর প্রেমের আদর নিজের শরীরে অনুভব করেই হালকা করে শীৎকার নিতে লাগল তিস্তা "রুদ্র...আমায় ইস্স..."
"কি..কি তিস্তা....বল মমম...বলও আমায়..." তিস্তার গালে ঠোঁটে নিজের প্রেমের চুম্বন বর্ষণ করতে করতে বলে উঠল রুদ্র...
" রুদ্র...আমি..উহ্হঃ..আমি..."
"এই তোর হল..? " বাথরুমের দরজার ওইপাশ থেকে দীপার গলার আওয়াজ আসতেই ওদের সেই অপূর্ব প্রেমের মুহূর্ত ভেঙে গেল"
"একিরে...কতক্ষণ ধরে ঢুকেছিস.....সব জল তো একাই শেষ করে দিবি...আর তিস্তা....তিস্তা কি তোকে কিছু বলে গেছে.....আমি ওকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না যে" চেঁচাতে চেঁচাতে বলে উঠল দীপা
"ধুর শালা...ভালো লাগেনা আমার...একদম " বলে না চাইতেও আস্তে আস্তে মেঝে থেকে উঠে রাগে গজগজ করতে লাগল রুদ্র আর তার এই অবস্থা দেখে হাসতে হাসতে গড়িয়ে যেতে লাগল তিস্তা | অন্যথা আর সময় নষ্ট না করে বাথরুমের দরজা খুলে মাথা নিচু করে আস্তে আস্তে বেরিয়ে এলো রুদ্র |
"কিরে...কি করছিলি এতক্ষণ ধরে....?" দীপা প্রশ্ন করে উঠল
"হাত মারছিলাম.....তাতে কোনও অসুবিধা আছে তোমার...? " বলে মুখ টিপে হাসতে হাসতে সিঁড়ি দিয়ে ওপরের তলায় চলে গেল রুদ্র | রুদ্রর কথার কিছু মাথা মুণ্ডু বুঝতে পেরে...আস্তে করে বাথরুমের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতে যেতেই এইবার তিস্তাকে বেরিয়ে আসতে দেখল দীপা , তবে নিজের মাথা লজ্জায় নিচু করে |
দীপাকে নিজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তিস্তা নিজের মাথা তুলে তার দিকে তাকাতেই দীপার হাসি ভরা মুখ ওর চোখে পড়ল | আস্তে করে নিজের মুখটা তিস্তার সামনে নিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল :
"এই...ভেতরে কি করছিলি তোরা ? বল না "
"সত্যি কথা বলবো তোমায়..দীপা দি ?" তিস্তা সেটা জিজ্ঞেস করতেই দীপা জোরে জোরে নিজের মাথা নাড়িয়ে 'হ্যাঁ' জানালো | "গল্প করছিলাম আমরা, পুরনো দিনের গল্প..."
তবে তিস্তার মুখ থেকে সেই উত্তর শুনবে সেটা দীপা একদমই আশা করেনি তাই সাথে তার সেই হাসি হাসি মুখটা দুঃখে ভোরে উঠল | করুন দৃষ্টিতে তিস্তার দিকে তাকিয়ে ওর গালে হাত দিয়ে বলল ঃ
"তিস্তা...আমি তোকে কি বলে...তুই না থাকলে"
"পুরনো কথা নিয়ে চিন্তা করোনা দীপা দি...সেটাই তো তুমি বলেছিলে আমাকে, তাই না ? তাহলে তুমিও চিন্তা করোনা..."
"কিন্তু..কিন্তু তিস্তা...সেইদিন যদি আমি রুদ্রর সাথে তোকেও নিয়ে....তাহলে...তোর এই অবস্থার জন্য আমিই দাই তিস্তা.....আমিই..." তবে নিজের কথা শেষ করার আগেই তিস্তা ওকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠল
"না একদম না দীপা দি, তুমি...তুমি কেন দাই হতে যাবে বলত.....আমার এই অবস্থার জন্যে একটা মাত্র জিনিস দাই আর সেটা হল আমার ভাগ্য" বলে দীপার গালে চুমু খেলো তিস্তা, তারপর " আজকের জন্য, আমায় ক্ষমা করে দিও দীপা দি...জেনে না জেনে আজকে তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি...তার জন্য আমাকে ক্ষমা করে দিও..." বলে নিজের হাত দুটো জোর করল তিস্তা
"এইবার টেনে একটা থাবড়া মারব...... চপ!!! বাচ্চা মেয়ে একটা...আবার মুখে এত বড় বড় কথা...যাহ্! ওপরে গিয়ে নিজের জামা কাপড় পর..." হাসি হাসি মুখ করে বলে উঠল দীপা, তারপর আবার বলে উঠল "আর একটু সাবধানে...ঠিক আছে? মানে যাই করিস না কেন আস্তে করিস কারণ এখন ডাক্তার-কাকুও আছেন আমাদের সাথে আর ওনার এই বয়সে ওইসব শুনতে পেলে..." বলে মুখ টিপে হাসল দীপা
"আইই! দীপা দি...তুমিও না...যাতা" বলে লজ্জায় নিজের মাথা নামিয়ে সিঁড়ি দিয়ে ওপরের ঘরের দিকে চলে গেল তিস্তা ।