৮৯.
পদ্মিনী তার অসহায়ত্বকে মেনে নিয়ে বিছানায় এসে শুয়ে পড়ে। পাশে রাখা মোবাইলটা হাতে নিয়ে সময়টা দেখে। রাত অনেক হল। জোর করে পদ্মিনী ঘুমানোর চেষ্টা করে। তবে বেশি চাপ প্রয়োগ করতে হয় না। কিছু সময় পড়ে আপনা-আপনিই ঘুম এসে পদ্মিনীকে শান্ত করে দিয়ে যায়!
অনেক সময় হতাশা ও দুঃসহ মানসিক চাপে থাকা মানুষগুলো একটু হলেও ঘুমোতে পারে বলে বেঁচে থাকে। নইলে বদ্ধ উন্মাদ হয়ে যেতো। মুখ দিয়ে মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সবার প্রতি রাগ আর ক্ষোভের কথাগুলো বলে বেড়াতো! কিন্তু কেউ তা শুনতে চাইতো না! নিজের বিরুদ্ধে বলা সত্য কথাগুলো শুনার মতো মহান যোগ্যতা সাধারণ মানুষের নেই!
ভোর হয়ে ওঠে। প্রতিদিনের মতো পদ্মিনী ঘুম থেকে ওঠে আজানের ডাকে। শৈশব থেকে পদ্মিনী পাশের মসজিদে আজানের সুর শুনে বড় হয়েছে। অর্থ না জানলেও আজানের গম্ভীর ধ্বনিতে কোথাও যেনো একটা ভক্তি শ্রদ্ধা আর বড়ত্বের গুণগান বুঝতে পারে। তার স্কুলজীবন থেকে ভার্সিটি পর্যন্ত গড়ানো বান্ধবী কুলসুম এর হিজাব পড়া মায়াবী মুখটা ভেসে ওঠে। কতদিন ওদের কারো সাথে কথা হয় না, যোগাযোগ হয় না। খবরে নিশ্চই শুনেছে পদ্মিনী একের পর এক লাশ ফেলে দিয়েছে কত অসহায় নারী -পুরুষের!
আচ্ছা? ওরা কি এসব বিশ্বাস করবে? আমাকে ছোটবেলা থেকে তো ওরা চেনে। ওরা কি পুলিশের কথা, নিউজ চ্যানেল আর পত্র-পত্রিকার বানোয়াট লিখা পড়ে বিশ্বাস করবে? করতেই পারে। মানুষ যা দেখে, যা শোনে তাই তো বিশ্বাস করে!
পদ্মিনীর চোখে জল এসে যায়। জীবনটা কি থেকে কি হয়ে গেলো! মান সম্মান কিছুই রইলো না! সবাই ওকে খুনী ভাবছে!
মাত্র ৩ ঘন্টা ঘুমানোর পরেও পদ্মিনী অলসতা না করে বিছানা ছেড়ে ওঠে। ঘরের কত কাজ আছে করতে হবে! ধর্ম যাই হোক না কেনো, সকল নারীর জীবন একই, ওখানে কুলসুম ঘুম থেকে উঠে নামাজ পড়বে, কুরআন পড়বে, তারপর নাস্তা বানাবে, এখানে পদ্মিনী স্নান সেরে দেবতাকে পূজো দেবে, তারপর সেও একই কায়দায় নাস্তা বানাতে বসবে।
কলেজে থাকতে এক মেয়ে ছিলো ক্যাথরিন নামে। খ্রীস্টান। বহুদিন হলো তার সাথে যোগাযোগ নেই। সেও সকাল সকাল উঠে নাস্তা তৈরী করতো বাবা আর ভাইদের জন্য। মেয়েটার মা নেই। তাই সব তার আর তার দিদিকে করতে হতো। তাই, নারীর জীবন সর্বত্র এক! মাঝখানে কেবল নীতি নিয়মের পার্থক্য।
পদ্মিনী উঠে দেখে তার মাও উঠে গেছে। তার মা অবশ্য তাকে দেখতে পায় নি। মা শুকিয়ে গেছে তার চিন্তায় চিন্তায়! পদ্মিনী এটা দেখে নিজেকে অভিশাপ দিতে থাকে! তার জন্য এই শেষ বয়সে বাবা -মা অসুস্থ হয়ে মরতে বসেছে! ওনাদের যদি কিছু হয় তবে ওর কি হবে? কার কাছে যাবে ও? ঐ পাষন্ড, লোভীটার কাছে? ওর কাছে এবার গেলে আর প্রাণে ফিরতে পারবে না! বাবা - মা না থাকলে এবার সে কোন কিছুরই তোয়াক্কা করবে না! মেরে লাশ ফেলে দিয়ে আসবে নদীতে!
পদ্মিনীর চোখের কোণে আবারও জল জমে যায়। কিন্তু সেটাকে পদ্মিনী আর মুছে ফেলেনা। চোখের জল আর কত লুকাবে সে? কিছুক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে তারপর ফ্রেশ হয়ে এসে নাস্তা বানানোতে মন দেয়।
ধেরাধুনের আরেকটি কর্মব্যস্ত দিনের শুরু হয়ে গেছে! সবাই ইট -পাথরের শহরে দূষিত পরিবেশে স্বার্থপর আর নিষ্ঠুর পরিমন্ডলে নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। রাজও উঠে ফ্রেশ হয়ে, নিজেই নাস্তা বানিয়ে খেয়ে বের হয়। আজকের নাস্তাটা বানাতে গিয়ে পুড়ে ফেলেছে কিছুটা! অন্যমনস্ক ছিলো। ঘুম থেকে উঠেই তার পদ্মিনীর বাসায় যাবার কথা মনে পড়ে। আগের রাতে যাবে ঠিক করে রাখলেও এখন যাবে কি যাবে না, দ্বন্দ্বে পড়ে যায়। তবে, শেষ পর্যন্ত সে যাবে বলেই ঠিক করে। আর এ ফাঁকে রুটি পুড়ে যায়।
রাজ, তোর কপালে পোড়া রুটিই আছে! যদ্দিন বেঁচে থাকবি ততদিন পোড়া রুটি, পোড়া তরকারী, বাসি তরকারী খেয়েই যেতে হবে। তারপর একদিন ক্রিমিনালের গুলি বা বোমায় ঠুস! রাজ মনে মনে ভাবতে থাকে।
তবে, কিছু শালাকে এনকাউন্টার না করে যাবো না! আগে আইন হাতে তুলে নিতাম বেআইনীভাবে! কিন্তু, এখন তুলে নিবো আইনীভাবে! হা হা হা!
পোড়া রুটি মুখে দিয়ে বেশ ক'বছর আগের অতীতে ফিরে যায় রাজ! তখন সে আজকের সভ্য সমাজে পুলিশ অফিসার হিসেবে পরিচিত ছিলো না! গোপন এক জগতের বাসিন্দা ছিলো যাকে সাধারণ মানুষ ভয় পেতো!
এমনি একবার ছোটা মাজনুকে টপকানোর দিন সকালেও সে পোড়া রুটি বানিয়েছিলো! রাজ প্রথমে বুঝতে পারেনি মোহিত এমনভাবে রিয়েক্ট করবে! রুটি মুখে দিয়ে গুরুর সে কি মেজাজ! বাবারে বাবা! মনে হয় যেনো রুটি পুড়িয়ে ফেলে মহা অপরাধ করে ফেলেছে!
ঐ! কি বানিয়েছিস এটা?
কি হল গুরু?
এটা হয়েছে? এমন পুড়লি কেমনে? এটা তো মুখেই দেয়া যায় না!
আসলে আমি মোবাইলে নটিফিকেশন চেক করছিলাম!
নটিফিকেশনের ********-
ধ্যাৎ! একটা শুভ কাজে যাবো আর তুই সকাল সকাল মেজাজটা খারাপ করে দিলি!
তারপরেও গুরু পেট ভরে পোড়া রুটি খেলো! কিন্তু মেজাজ গরমই রইলো! পুলিশের ভ্যানে বসে অপারেশনে যাবার আগেও পুরো রাস্তা মুড অফ করে ছিলো। সিগারেট ফুকিয়ে মুড চাঙা করার চেষ্টা করলো কিন্তু হলো না! আর তাই মনে হয়, ছোটা মাজনু ঘাউরামী করার কারণে ওর মাথায় টুল দিয়ে মেরে মাটিতে ফেলে ওর হাতে পারা দিয়ে কব্জিতে আর কব্জির নিচে দুটো গুলি করে বসে! রাজ তখন দেখতে পায় মোহিতের মেজাজ চরমে! সেদিন মাজনুকে সে মেরেই ফেলতো যদি না ইন্সপেক্টর শাস্ত্রী তাকে নিয়ম নীতির লেকচার দিয়ে থামিয়ে না দিতো!
এই! কি করছেন আপনি! আরে! ধ্যাত! স্টপ! স্টপ!
কি অফিসার?
আপনি মেরে ফেলবেন নাকি ওকে?
আপনি দেখেছেন কি বলেছে ও আমাকে? রান্ডীকা বাচ্চা বলেছে আমাকে ও!
হ্যা আমি দেখেছি! প্লিজ লিভ হিম! ওকে জীবিত দরকার আমাদের!
মোহিত মাজনুর পাছায় লাত্থি দেয়!
আহ! গুরু! সামনে ইলেকশন! এমএলএ সাহেব এটা পছন্দ করবে না! ওনার ইমেজ খারাপ হবে!
আর রাখ তোর ইলেকশন! উনি এমনিই পাশ! রনদা প্রসাদ তো রাস্তা থেকে কেটে পড়েছে! এমএলএ সাহেবকে ঠেকানোর কেউ নেই!
বুঝলাম। গুরু! রাখো! প্লিজ!!
আহ! তুই থামতো!
দেখুন মোহিত আপনার পিছনে পলিটিশিয়ান আছে দেখে আপনি কিন্তু যা খুশি করতে পারেননা! অনেক বাড় বেড়েছেন আপনি!
ধুর অফিসার! আপনি বড্ড লেকচার মারেন! আপনি নিজে কি তোষামোদ করেন না এমএলএ বাবুকে? কমিশনার হয়ে ছড়ি ঘুরানোর শখ যে আপনার জেগেছে তা কি আমরা জানি না!
ইন্সপেক্টর শাস্ত্রী চুপ করে থাকে!
মোহিত ঘুরে চলে যেতে নেয় তারপর ফিরে এসে মাজনুর গালের উপর পারা দেয়!
ওদিকে মাজনুর অবস্থা তখন মাথাবিহীন মুরগীর মতো! সে মুখ দিয়ে আর্তনাদ করে!
আরেকদিন যদি আমার সামনে পড়িস তবে কিন্তু টিকিট ছাড়া তোর ভাতিজার কাছে পরপারে পাঠিয়ে দেবো!
চল রাজ!
এই মোহিত ওর ভাতিজাকে কি আপনিই...!
আরে ধুর মশাই! আমি কি পুরো রাজ্যের সন্ত্রাসী মারার সুপারী নিয়ে রেখেছি?
তাহলে?
আরে স্যার ওকে মেরেছে ওরই এন্টি, বদু গ্রুপের লোকেরা! চলি স্যার! সন্ধ্যায় আসছি এমএলএ সাবের বাসায়! চলো গুরু!
চল রাজ!
গুরু কোথায় যাবে এখন?
খেতে যাবো! যে রান্না খাইয়েছিস তুই। ভিতরে সব তিতা হয়ে গেছে! এখন রেস্টুরেন্টে যাবো!
মন চাইছিলো মাজনু হারামজাদার উপর রিভলবার খালি করে দেই! গালিটা কি দিয়েছে দেখেছিস?
হুম।
রাজ বুঝতে পারে তার রান্নার স্বাদ এখনও মোহিতকে তিক্ত করে রেখেছে!
রাজ খাবার টেবিলে খারার নিয়ে খেতে বসে।
বেচারা মাজনু! এ জনমে আর ঐ হাতে গুলি করতে পারবে না, এমনকি সে হাতে খেতেও পারবে না! তাকে খেতে হবে বাম হাতে!
তবে গুরু কিন্তু পক্ষপাতিত্ব করে!
সে নিজেই প্রায়ই তরকারী পুড়তো আর খেতে বসে প্যান প্যান করতো। কিন্তু আমি কিছু বললেই খ্যালখ্যাল করে উঠতো!
ধুরও! আজকেও পুড়ে গেলো! এই ধরতো!
কি হলো তোর?
আরে গুরু পোড়া গন্ধ!
হা তো? মানুষের চামড়া পোড়া গন্ধের মতো তো আর না! ঢাকনাটা সরিয়ে ড্রামের উপর রাখ!
গুরু খাবো কিভাবে এটা!
কিভাবে মানে? এমনেই খাবি!
না না!
কি না! আরে যা। প্লেট লাগা!
আচ্ছা।
ঐ কিরে খা!
গুরু তিতা লাগছে।
আমি খাচ্ছি না! খা!
হুম।
কি মজা লাগছে না? কপালে যে এটা জুটেছে এখন এটাই বেশি! এটা আমার বাসা! এটা মুম্বাইয়ের ফাইভ স্টার হোটেল না! যা জুটছে খা!
ওকে।
বিয়ে করে বউর হাতে খাস!
হুম। খাবো। তবুও তোমার রান্নার চেয়ে চেয়ে ভালো খাবো।
হ্যা হ্যা খাস!
পদ্মিনীর রান্নার কথা মনে পড়ে রাজের। আহা! কি দারুণ রান্না ছিলো! কেবল রান্নারই প্রেমে পড়ে যাওয়া যায় এমন অবস্থা! কিন্তু কি আর করা! এত হৃদয় নেই রাজের যেটা দিয়ে আলাদাভাবে তার রান্নার প্রেমে পড়ে যাবে!
তারপর খেতে খেতে গম্ভীর হয়ে ওঠে রাজ! ধীরে ধীরে ইউনিফরমটা গায়ে চড়িয়ে সার্ভিস রিভলবারটা নিয়ে জায়গামতো রাখে।
এ রিভলবার তার কাছে নরমাল লেভেলের মনে হয়। কত আপটুডেইট রিলভলবার চালিয়েছে। এ তো কিছুই না! ভাগ্য কাকে কোথায় নিয়ে আসে! নেতার সাথে বসলে কবেই তার চাকুরী হয়ে যেতো। কিন্তু সে সৎভাবে পুলিশের চাকুরী পাবার চেষ্টা করেছে। কত চাকুরী পাবার যোগ্য থাকলেও পায়নি!
অর্থ, নারী, ভোগ বিলাসের জীবন ছেড়ে সাধাররণ জীবন যাপন করার সিদ্ধান্ত নিয়ে আজ সে সাধারণে পরিণত হয়েছে। আসলে অন্ধকারের পথে আর ভালো লাগছিলো না। তার মতো গুরু মোহিতও আর চাইছিলো না এ ধরনের জীবন। যার কোন সুন্দর ইতি নেই এমন জীবনকে আঁকড়ে ধরে রাখতে। তাই, হেমন্তের এক সন্ধ্যেবেলায় দুজন সব কিছু পেছনে ফেলে অন্য পথে হাঁটতে শুরু করে! পেছনে ফেলে আসে কত নেতার স্বার্থের বড় বড় হাত, ছোট- বড় কুকীর্তি, কত অস্ত্রের খেলা, কত উত্তেজিত নারী, আর অসংখ্য নরপিশাচ যারা তাদের মৃত্যু কামনা করতো প্রতিদিন! কারণ তারা তাদের কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিলো!
রাজ বের হয়ে প্রথমে পুলিশ স্টেশনে যায়। সেখানে সরকারি চাকুরেদের মতো হাজিরা খাতায় সই করে বেরিয়ে আসে। বেরিয়ে জিপে উঠে বসে।
আজও নিজেই ড্রাইভ করতে শুরু করে। তার গন্তব্য এখন পদ্মিনীর বাড়ি। গাড়ি চলতে শুরু করে। পুরোনো স্মৃতি ভর করে আর রাজ ভাবুক হতে থাকে।
নাহ! পদ্মিনীর সামনে ইমোশনাল হওয়া যাবে না। কারণ লাভ নেই। বরং তার ইমোশন যদি পদ্মিনী বুঝতে পারলে তার কাছে ছোট হয়ে যেতে হবে। তাই রাজ নিজের মনকে স্থির করে গাড়ী ড্রাইভ করতে থাকে।