সুন্দর শহরের ঝাপসা আলো (পর্ব-৩১)
অটোরিকশায় বসে, ডান দিকের জানালায় মুখ ঘুরিয়ে আনমনা হয়ে বাইরের দিকে চেয়ে ছিলো সঞ্জয় । প্লাটফর্মের মর্মান্তিক দুর্ঘটনার চাক্ষুস অভিজ্ঞতার রেশ তখনও ওর মন থেকে মুছে ফেলতে পারেনি ।হৃদয়ের গতি তখনও স্বাভাবিক হয়ে ওঠেনি ওর । সারা শরীর কেমন যেন মৃদু তালে কাঁপছে ।আর মনে একটা চাপা আনচান ভাব । অনেকক্ষণ সময় লেগেছিলো এটা বিশ্বাস করতে যে ওর মা মারা যায়নি ।বরং বেঁচে আছে সে । এ যেন এক কঠোর দুঃস্বপ্নের থেকেও চরম বাস্তব বলে মনে হয়েছিলো তাকে যে মা তার এই পৃথিবীতে নেই ।
সেতো ধরেই নিয়েছিলো যে স্টেশনে আত্মহত্যা করা নারী তারই মা ।যার ফলে কঠোর আত্মবিলাপে ভেসে গিয়েছিলো সে ।
জীবনের এই চূড়ান্ত পরিস্থিতিতে, মা তাকে ছেড়ে চলে যাবে । সেটা কখনো চায়না সে । মায়ের জন্যই তার সবকিছু । জীবনে যা কিছু হতে চায় সে, সবকিছুই মায়ের জন্য ।
এখন সে বুঝতে পারছে, মা ছাড়া তার জীবন অচল । সুতরাং জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে না পারলে মায়ের প্রতি অবিচার করবে সে।মায়ের সমস্ত পরিশ্রম বৃথা যাবে যদি না সে কোনো সফল মানুষের মতো নিজেকে গড়ে ।
মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে সে । আর অবহেলা নয় । আর সময় নষ্ট নয় । এই নারীকে যদি সম্পূর্ণ মর্যাদা দিতে হয় তাহলে নিজের লক্ষ্য স্পষ্ট রাখতে হবে । সুতরাং একাগ্রতা এবং কর্তব্যে আর ঢিলেমো নয় । তাতে সময় শত বিপরীত হোক না কেন । তাতে দুবেলা আহারের অনিশ্চয়তা আসুক না কেন । লক্ষ্য অর্জন করেই ছাড়বে।
জানালার বাইরের দিকে মুখ করে এই সব ভাবতে ভাবতে একবার ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখে নেয় সঞ্জয় ।
সুমিত্রার নজর তখন সামনের দিকে ছিলো । আর ওর গালের দুপাশের চুল গুলো এলোমেলো হয়ে উড়ছিলো আর নিজের ডান হাত দিয়ে কানের পেছনে সেগুলোকে গুঁজে দিচ্ছিলো এক দুবার করে ।
ছেলে তার মুখের দিকে ক্যাবলার মতো করে চেয়ে ছিলো, সেটা বুঝতে পেরে সে মুচকি হেসে তার দিকে চোখ ফেরায় ।
গত রাত থেকেই ছেলের মন খারাপ । তার উপর আজকে সকালের অঘটন ওর মনকে অনেক খানি ক্ষতবিক্ষত করে তুলেছে সুতরাং মুখের এই কৃত্রিম মুচকি হাসি দিয়ে তার মন ভোলাতে হচ্ছে ।
সুমিত্রা ছেলেকে এখন কিছু বলতে চায়না । শুধু মাথায় একবার হাত বুলিয়ে হাল্কা আদর করেই ছেড়ে দেয় ।
তারপর আবার সামনের দিকে চোখ রাখে সে ।
ওরও অন্তরমন যে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে তার বহিঃপ্রকাশ সে কার কাছে করবে? কে আছে এই দুনিয়ায় ওর কান্নার মর্ম বুঝবার মতো?
গতরাত সে ঘর ছেড়ে দিয়েছে ।নিশ্চিত করে ফেলেছে যে সে আর নিজের স্বামীর সাথে সংসার করবেনা ।একলাই দুচোখ যেদিকে যায়, ছেলেকেও বগল দাবা করে সেখানে নিয়ে গিয়ে থাকবে । জীবনে অনেক কিছু দেখলো সে । কচি বয়স থেকে গ্রাম ছাড়া হয়ে এই ধুন্দুমার শহরে আসা । সুখের সংসার করবে বলে ।স্বামীর ভাত খাবে বলে । স্বামীর ভালোবাসায় বলিয়ান হয়ে সুখের অথৈ সাগরে হাবুডুবু খাবে বলে ।
কিন্তু একি হলো তার জীবনে । এমন টা তো নাও হতে পারতো । কিসের কমি পড়ে গিয়েছিলো তার অদৃষ্টে? যে এমন সংঘর্ষ পেলো জীবনে ।
অটোরিক্সার আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে সুমিত্রা । নিজেকে নিজের সামনেই চোখাচুখি হয়ে প্রশ্ন করে সে । অন্তরমন বলে ওঠে, “নারীর রূপই নাকি নারীর ভাগ্য বলে দেয়”। আর লোকের মুখে সে শুনে এসেছে যে সে নাকি রূপসী । আর এই রূপসী নারীর ভাগ্য কেন এতো কুৎসিত ভগবান?
মনে মনে কথা গুলো বলতে বলতেই আর আয়নার সামনে নিজের চোখে চোখ রাখতে পারেনা সুমিত্রা ।
ভেতরটা কেমন জ্বলে ওঠে ।আর ছেলে যদি ওর কান্না মুখ দেখে তাহলে আরও ভেঙে পড়বে সে । সুতরাং নকল হাসির মুখোশ পরে থাকতেই হবে তাকে ।
মায়ের মুখের মৃদু হাসি দেখে মন ক্ষনিকের জন্য শান্ত হলেও, বারবার ওর মাথায় আসতে থাকে, স্টেশনে আত্মহত্যা করা নারী যদি সত্যিই তার মা হতো তাহলে??
সেকি বাঁচতে পারতো একাকী এই নিষ্ঠুর দুনিয়ায়?
যেখানে আপন বলতে তার মা ছাড়া আর কেউ নেই । কি হতো তার এই অসহায় জীবনে?
কে দেখতো তাকে? কার আশায় বাঁচতো এই জীবন?
ডান গালে নিজের হাত মুঠো করে রেখে আপন মনেই ভাবতে থাকে সে । সামনে বসে থাকা এই নারীর মিথ্যা মৃত্যুর দুঃসংবাদ পেয়েই ওর এই অবস্থা । তো যখন সত্যিই এই নারী মৃত্যুকে প্রাপ্ত হবে তখন ওর কি হবে? এই নারী একদিন না একদিন তো এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবে তখন তার কি হবে? এই নারীও অন্যান্য মানুষের মত নশ্বর । এই নারীও একদিন মরবে তখন?
এই সব কথা মনে আসতেই অনায়াসে চোখের জল গড়িয়ে আসে সঞ্জয়ের দু চোখ দিয়ে ।বহু চেষ্টা করেছে সে কিন্তু অশ্রু যেন অবাধ্য শিশুর মতো আপন জেদেই চোখ নাক দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে ।
সুমিত্রাও অটোরিকশায় বসে অপেক্ষা করতে থাকে ওর আগামী গন্তব্যস্থলের জন্য । একটা নতুন জায়গায় নতুন ভাবে কাজ শুরু করতে চায় সে ।
যেখানে আর কিছু নয় অন্তত দস্যি ছেলেদের অসভ্য ভ্রুকুটি সহ্য করতে হবেনা তাকে ।
বাম দিকের বাইরের জানালায় চোখ রেখে একবার দেখে নেবার চেষ্টা করে আর কতদূর ।
তারপর আচমকা ছেলের দিকে চোখ ফেরায় ।ছেলের চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে ওর নরম গাল বেয়ে ।
তাতেই সুমিত্রার মন আবার ভেঙে যায় । কিন্তু মাকে, ছেলের কাছে কাঁদা বারণ । বুকের বেদনাকে ঢোক গিলে নিবারণ করার চেষ্টা করে সুমিত্রা ।
শুধু নিজের আঁচল দিয়ে ছেলের চোখ মুছিয়ে দিয়ে একটু শক্ত করে তার মাথা চেপে ধরে নিজের নরম বুকের সামনে ।আর নিম্ন স্বরে বলে, “কাঁদতে নেই সোনা । এইতো আমি আছি । কোথাও যায়নি তোকে ছেড়ে”।
তখনি অটোরিকশা দাঁড়ানোর শব্দ পায় তারা । অটো চালক বলে, “আপনাদের গন্তব্যস্থল চলে এসেছে দিদিভাই এবার নেমে পড়ুন”।
অটোরিকশা থেকে নেমে চোখ তুলে তাকায় সুমিত্রা । সামনে বিশাল দুতলা বাড়ি । নিচে আর উপর তোলা মিলে একজন বিধবা বৃদ্ধা মেস বানিয়ে রেখেছেন ।কেবলমাত্র মেয়ে দের জন্য ।
সুমিত্রা সঞ্জয়কে নিয়ে দরজায় টোকা দেয় ।
কিছুক্ষনের মধ্যেই একজন মহিলা বেরিয়ে এসে ওদের ভেতরে যাবার অনুমতি দেন।
কিন্তু সঞ্জয়কে রিসোপশনেই বসে থাকতে হয় । কারণ ভেতরে পুরুষ মানুষের অনুপ্রবেশ কঠোর রূপে নিষিদ্ধ ।
সুমিত্রা ভেতরে গিয়ে বৃদ্ধা মালকিনের সাথে নিজের কাজের বিষয়ে সবরকম কথাবার্তা বলে নেয় ।
বৃদ্ধা তো সুমিত্রাকে পেয়ে বেজায় খুশি । কারণ ওর উপস্থিতির মধ্যেই একটা আলাদা বৈশিষ্ট আছে, যেটা যেকোনো মানুষকেই ওর সাথে মিলে মিশতে সহায়তা করে ।
বৃদ্ধা ওকে এখানে পূর্ণ স্বাধীনতায় কাজ করার অনুমতি দেয় । আর থাকা এবং টাকা পয়সার বিষয়েও একটা নিশ্চিত আশ্বাস দেয় যে ওর এখানে কোনোরকম অসুবিধা হবে না ।
তবে বৃদ্ধা এখানকার নিয়ম কানুন নিয়ে বেজায় সচেতন সেহেতু মূল সমস্যা টা হয়ে দাঁড়ায় সঞ্জয়কে নিয়ে । কারণ সুমিত্রা তো আরও বাকি তার সহযোগী মহিলাদের সাথে নিজের রাত্রি বাস করে নেবে কিন্তু সঞ্জয়ের জন্য এখানে তাদের কোনো রকম ব্যবস্থা করা নেই ।
সঞ্জয় ছেলে মানুষ । তার থেকে বড়ো সমস্যা হলো ও একজন পুরুষ । যার স্থান এই লেডিস হোস্টেলে নেই ।
সুমিত্রা এই বিষয় নিয়ে একটু চিন্তিত ছিলো কারণ ওর কিছু করার ছিলোনা । সেও নীরব ছিলো এই ব্যাপারে ।
বাইরে বেরিয়ে মা ছেলে একে ওপরের মুখ চাওয়া চায়ি করছিলো । ছেলে কি তাহলে বাবার কাছে ফিরে যাবে এবার? নাকি বস্তিতেই থেকে যাবে অন্য কারো বাড়িতে?
নাকি এই সমস্যার জন্য ওকে এই চাকরি ছেড়ে দিতে হবে?
ভাবতে থাকে সে ।
মায়ের এই রকম ধর্মসংকটের মুহূর্তে সঞ্জয় এগিয়ে আসে । সে বলে, “মা তুমি এখানে থেকে যেও । আমি নাহয় অন্য কোনো ব্যবস্থা করছি । রাত্রি ঠাঁইয়ের ব্যাপার । ওটা সামান্য । প্রয়োজন হলে আমি ফুটপাতে, বাসস্ট্যান্ড এও ওই সময় টুকু পের করে নিতে পারি”।
সুমিত্রা ছেলের কথায় বিচলিত হয়ে বলে, “না…। এমন বলিস না বাবু । থাক । এর চেয়ে বরং আমরা অন্য কোথাও কাজ দেখি”।
তখনি ভেতর থেকে বৃদ্ধা বেরিয়ে আসে । সে সুমিত্রা কে বাধা দেয় । কারণ তিনি চাননা যে সুমিত্রার মতো মেয়ে তার কাজ ছেড়ে দিয়ে অন্যত্র চলে যাক ।
বলেন, “দাঁড়াও সুমিত্রা । আমি তোমার ছেলের থাকার জন্য ব্যবস্থা করে দিচ্ছি । তুমি কাজটা ছেড়োনা”।
তারপর মেসের দারোয়ান কে ডেকে পাঠান ।
কিছুক্ষনের মধ্যেই একজন মাঝ বয়সী লোক এসে দাঁড়ায় ।ইনিই এই মহিলা ছাত্রাবাসের একমাত্র পুরুষ মানুষ । এখানকার পাহারাদার ।
বৃদ্ধা তাকে নির্দেশ দেয় । যে সঞ্জয় কে রাত্রি টুকু যেন তার কাছেই ঠাঁই দেয় ।
পাহারাদারের নাম ধনঞ্জয় । তিনি এই ছাত্রাবাসের সামনে একটা দশ বাই দশ ফুটের কামরার মধ্যে থাকেন । এবং ওখান থেকেই গার্ড দেন ।অত্যন্ত প্রয়োজন না হলে তিনি এই হোস্টেল চত্বরে প্রবেশ করেন না ।
যাক সঞ্জয়ের ও তাহলে রাত্রি কাটাবার মতো উপযুক্ত জায়গার সুরাহা হয়ে গেলো । সুমিত্রা তাতে একটু স্বস্থির নিঃশাস ফেলল ।
সেদিন থেকেই সুমিত্রা নিজের কাজে মন দিলো । রান্নাবান্না করে সেখানেই আরও দুজন সহযোগী মহিলার সাথে এক কামরায় কোনো রকমে সেদিন টা পার করে দিলো ।
সঞ্জয় ও বস্তির স্কুল থেকেই পড়াশোনা করছিলো । শুধু থাকা খাওয়াটা এখান থেকে করে নিতো সে । বাকি কাজ কর্ম বন্ধুবান্ধব সব তার বস্তির মধ্যেই আছে ।
এভাবেই আরও একটা দিন কেটে যায় ।
পরেরদিন সকালবেলা । প্রায় সাড়ে নয়টা পৌনে দশটা বাজবে । সঞ্জয় স্কুল যাবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলো ।
ছাত্রা মেসে প্রবেশ নিষেধ ওর । সেহেতু ওকে বাড়ির পাশের দরজা দিয়ে পেছন দিকে মায়ের রান্না ঘরে যেতে হচ্ছিলো খাবার খাওয়ার জন্য ।
তাতেও যে খাবার ঘরে বসে তৃপ্তি করে খাবার খাবে তার উপায় নেই ।
ওকে রান্নাঘরের বাইরে বাগানে খোলা আকাশের নিচে দুটো চেয়ার কে নিয়ে একটা তে বসে আর অন্য তাকে টেবিল বানিয়ে ওর উপর ভাতের থালা রেখে খেতে হচ্ছিলো ।
এতো সকালে মায়ের রান্না সম্পূর্ণ হয়না । তাই আধ সেদ্ধ ডাল ভাত খেয়েই ওকে স্কুল যেতে হয় ।
সঞ্জয় তখন আপন মনে খাবার খেয়ে যাচ্ছিলো । আর মা সুমিত্রা সামনে দাঁড়িয়ে নিজের ছেলেকে খাবার খেতে দেখছিলো । পেছন দিকে দুহাত দিয়ে দাঁড়িয়ে ।
আগন্ত শীতের মৃদু রৌদ্রের আলো গায়ে লাগছে তার । পরনে হলুদ সুতির ছাপা শাড়ি এবং কমলা ব্লাউজে ওর গমের রঙের ত্বক প্রজ্জলিত হচ্ছিলো ।বাগানের হলুদ গাঁদা ফুল এবং হলুদ পাতা বাহার গাছ আর হলুদ সূর্য রশ্মি ওর শারীরিক সৌন্দর্যতা কে পরিপূর্ণ করে তুলেছিল ।
ঈষৎ সূর্যালোক ওর চোখের পাতায় আসায় মাঝে মধ্যেই মুখ কুঁচকে, হাতের তালু ঢেকে সেটার থেকে বাঁচার চেষ্টা করছিলো সুমিত্রা ।
মায়ের পাতলা গোলাপি ঠোঁট এবং টিকালো নাকের পাশে বিন্দুর মতো নাকছাবি কেমন উজ্জ্বল তারার মতো চকচক করছিলো ।
মায়ের মুখ দেখে বোঝো যায় তার মন এখন শান্ত, তৃপ্তি এবং দুশ্চিন্তা মুক্ত । কারণ ছেলেকে খেতে দেখে তার মনের একটা আলাদাই তৃপ্তির আভা দেখতে পাওয়া যায় ।
সঞ্জয়কে মা যতটুকুই খাবার এনে দেয়, অতটুকুই পরিপাটি করে খেয়ে নেয় সে । ভাতের একটা দানাও সে নষ্ট করেনা । আর বাড়তি খাবারও চায়না সে মায়ের কাছে । কারণ মা জানে ওর খাবারের পরিমাপ ।
সুমিত্রার ও ওখানে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকার একটাই উদ্দেশ্য । ছেলের খাওয়া শেষ হলেই সে বাসন পত্র তুলে নিয়ে গিয়ে মাজতে বসবে ।
এমন মুহূর্তে পেছনেরই গেট দিয়ে কয়েকজন মানুষের আসার শব্দ পায় তারা । সুমিত্রা একটু আশ্চর্য হয় তাতে । কারণ কোশমিন কালেও এদিকে বিশেষ কোনো প্রয়োজন ছাড়া কেউ আসে না ।
ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে একটা বিস্ময় ভাব নিয়ে উঁকি মেরে দেখে সুমিত্রা । থুতনিতে নিজের হাত রেখে ।আরেকটা হাত নিজের বুকের নিচে আড়াআড়ি ভাবে রেখে ।
চোখের সামনে দাদা!!! সাথে আরও একজন লোক । ধনঞ্জয় ওদের এখানে রাস্তা দেখিয়ে চলে যায় ।
বিশ্বাস হয়না সুমিত্রার । সামনের মানুষটা ওর নিজের দাদা । ক্লান্ত অবসন্ন শরীর নিয়ে । গলায় গামছা । পরনের জামাটা কেমন নোংরা হয়ে গেছে । মাথার চুল গুলো এলোমেলো । ঠোঁট শুকনো । পায়ের চটি গুলো কেমন ধুলোতে মলিন হয়ে আছে । সাদা ধুলোতে পা একেবারে ঢাকা । দেখলেই বোঝো যায় মানুষটা যেন অনেক খানি পথ পায়ে হেঁটে এসেছে ।
চোখ দুটো লাল এবং তার কিনারা দিয়ে অশ্রুর বিন্দু, ধারা রূপে এই যেন বেয়ে পড়বে বোধহয় ।
মানুষটা যেন দীর্ঘ দিন না ঘুমিয়ে থেকেছে ।মুখে একগাল না কামানো কালো দাড়ি এবং তার মাঝখানে খোঁচা খোঁচা বেশ কয়েকটা সাদা দাড়ি উঁকি মারছে ।
কাঁধে একটা পুটলি। আর সেটাও যেন মলিন হয়ে এসেছে ।
ওপর দিকে এই কয়দিনে চোখের পাতা এক করতে না পারা দীনবন্ধু, আদরের বোনকে কাছে পেয়ে খুশির সীমানা নেই ওর ।ভেবে ছিলো বোনটা আমার আর এই পৃথিবীতে নেই । তবে এখন তাকে জলজ্যান্ত চোখের সামনে দেখতে পেয়ে ভগবানকে অসংখ্যবার ধন্যবাদ জানাচ্ছে মনে মনে ।
কিন্তু কি হালত হয়েছে ছোট বোনটার ।সুন্দরী সতেজ মুখ খানা কেমন নির্জীব হয়ে গিয়েছে । চোখ দুটো বসে গিয়েছে । মনে অনেক কষ্ট পেয়েছে মেয়েটা ।
কাঁপা কাঁপা ঠোঁট নিয়ে, কাঁদো গলায় সুমিত্রার দিকে এগিয়ে আসে দীনবন্ধু । মুখ থেকে অনায়াসে বেরিয়ে আসে শব্দ, “মা…..! মা আমার কত খারাপ হয়ে গিয়েছিস তুই। কি করে হলো তোর এই এমন দশা । এমন তো ভাবিনি মা আমার এতো কষ্টে আছে এখানে । দুস্টু লোকটা বলে কি না তুই মরে গিয়েছিস…”।
কয়েক যুগ পর দাদাকে সামনে থেকে দেখছে । সুমিত্রার বিশ্বাস হয়না । জীবনে এতো ঝড় ঝাপটা সহ্য করার পর দাদা তাকে দেখতে এসেছে । দাদার বিমর্ষ মুখ । চোখে জল । কাঁপা ঠোঁট এবং মুখে মায়ের সম্বর্ধনা ।
নিজের আবেগ ধরে রাখতে পারে না । দৌড়ে যায় দাদার কাছে । পায়ের ধুলো মাথায় নেয় । তারপর হাঁউমাঁউ করে কাঁদতে শুরু করে দেয় দুইজন ভাই বোন মিলে ।
দাদার বুকে মাথা রেখে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কাঁদতে থাকে সুমিত্রা । সজোরে মন উজাড় করে নিজের বেদনা মেলে ধরে মেয়েটা ।কোনো সরম কোনো হায়া নেই । কে দেখলো কি বলল সে নিয়ে বিন্দু মাত্র চিন্তিত নয় সে । আজ মনের আবেগ খোলার সুযোগ হয়েছে তার । তাই সে শুধু কাঁদতে চায় । মন প্রাণ খুলে ।নিজের দাদার কাছে ।
যেন সে তার দাদা নয় বরং কোনো দেবদূত এসেছে ওর দুঃখ দুর্দশার কথা শুনতে । প্রতি নিয়ত ভগবানের কাছে প্রার্থনা করে এসেছে সে । নিজের কষ্টের কথা ভগবান কে জানিয়েছে । পরিস্থিতি অনেক পরীক্ষা নিয়েছে ওর । এখন আর সহ্য হয়না ।ধর্য্যের বাঁধ ভেঙে পড়েছে ।
তাই দাদা রূপী এই ভগবানের প্রেরিত দূত কে নিজের সর্বস্য দুঃখ দুর্দশার কথা এক এক করে জানাবে সে ।
সুমিত্রার চোখের জলে বুকের কাছটা ভিজে গেলো দীনবন্ধুর ।
কাঁদো গলায় সমানে বলে যাচ্ছে নিজের আর্তনাদ মিশ্রিত অভিযোগের কথা ।
“দাদা তোমরা কেন দিলে আমায় এখানে বিয়ে……। দাদা……!!”
“জানো আমি কত কষ্ট পেয়েছি এখানে এসে । প্রতি নিয়ত যাতনা সহ্য করতে হয়েছে আমায় । কত লাঞ্ছনা । কত অপবাদ । বেশ্যা । পর পুরুষের সজ্জা সঙ্গিনী…”।
“প্রতিদিন আমি নরম গায়ে কঠোর প্রহার সহ্য করেছি দাদা ।নিজের পেট চালানোর জন্য অন্যের এটো বাসন মেজেছি দাদা…”।
বোনের প্রত্যেকটা অভিযোগ যেন তীরের মতো হৃদয়ে গাঁতছে । অনেক বেদনা হচ্ছে দীনবন্ধুর । অনর্গল চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে । ছেলে ছোট কারখানায় চাকরি করে বলে বিয়ে দিয়েছিলো । কিন্তু বোনকে পরের ঘরের ঝি বানিয়ে রাখবে এটা সে স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি । গাঁয়ে শত খরা । শত আকাল পড়লেও ঘরের মা বোনকে গ্রামের বামুন মোড়লের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করতে দেয়নি দীনবন্ধু । কিন্তু এখানে নিজের আদরের বোন অন্যের এটো সাফ করে জীবন চালাচ্ছে সেটা ভেবেই ওর মন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো ।
সুমিত্রা যেন নিশ্চিত করে ফেলেছে দাদাকে আজ সব মনের বেদনা ব্যক্ত করবে । কেঁদে কেঁদে চোখের জল ফেলে দাদার মুখের দিকে চেয়ে আঙুলের ইশারায় একটা একটা করে নিজের নালিশ জানাচ্ছে সে ।
“কোনদিন আধপেটা খেয়ে থেকেছি । কোনো দিন জ্বর জ্বালা হলেও কাউকে মুখ ফুটে বলতে পারিনি যে আমায় ডাক্তার দেখাক….”।
“ওই দানব লোকটা আমাকে পশুর মতো মারতো দাদা । আর সাথে অমানবিক গালাগালি”।
ছোট্ট শিশুর মতো ক্রন্দনরত বোনের করুন কাহিনী শুনে দীনবন্ধু চোখের জল নিয়ে বলে, “আমাদের ভুল হয়ে গিয়েছে মা । তোকে এখানে বিয়ে দিয়ে । আমরা বুঝতে পারিনি তোর উপর এতো অত্যাচার হয়েছে । চল মা ঘরে ফিরে চল । গ্রামে । শাক ভাত খেয়ে থাকবি ওখানে”।
ওদিকে সঞ্জয় মায়ের এই রূপ দেখে স্তম্ভিত। স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে ছিলো । মাকে এইভাবে কাঁদতে সে জীবনে দেখেনি । এভাবে নিষ্পাপ শিশুর মতো নিজের অভিভাবকের কাছে নিজের অন্তর বেদনা অভিবাক্ত করছে ।
সত্যিই মাকে এর আগে সে ভাবুক হয়ে বসে থাকতে দেখেছে । নীরব চোখের জল দেখেছে ।বেদনা চাপা মুচকি হাসিতে দেখেছে । কিন্তু এভাবে আর্তনাদ করতে দেখেনি । সে ভাবতো মা সহ্য এর এক প্রতিমূর্তি । মায়ের অনেক সাহস এবং ধর্য্য আছে । মা শত প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও অনড় থাকে । মায়ের মন অনেক শক্ত । কিন্তু আজ সে বুঝলো । মা তার কাছে শুধু মাত্র অভিনয় করে এসেছে ।
মা হয়তো তাকে সেরকম উপযুক্ত মানুষ বলে মনে করেনা । যার কাছে সে নিজের মন খুলে বলতে পারবে । মা হয়তো তাকেও ওর বাবার মতো নরাধম বলে মনে করে । হয়তো মা তাকে ভালোই বাসেনা ।
মায়ের কান্না দেখে সেও ভেঙে পড়ে । খাবার খেতে খেতে অনর্গল চোখের জল গড়িয়ে এসে ভাতের থালায় পড়ে ।
মন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলতে চায়, “মা আমি অপরাধী । আমি তোমার মনের বেদনা বুঝতে অসমর্থ । আমায় ক্ষমা কর মা । আমি বুঝতে পারিনি তোমার মনে এতো বেদনা জমা হয়ে আছে । তোমার ভালোবাসা দেখেছি । তোমার যত্ন দেখেছি । তোমার শাসন ও দেখেছি । কিন্তু এভাবে তোমাকে কাঁদতে দেখিনি মা । তোমার এই কান্না আমার সহ্য হচ্ছে না মা । আমি তোমাকে ভালো বাসি”।
মনের মধ্যে কাঁদতে কাঁদতে হাত পা ছড়িয়ে বসে থাকে সঞ্জয় । শুধু চোখের জল গড়িয়ে খাবারে মিশে যায় ।
ওদিকে বোনের কান্নায় ভেজা চোখ নিজের গামছা দিয়ে মুছিয়ে দেয় দাদা দীনবন্ধু । বলে, “চুপকর মা আমার । চল তোকে আর এখানে থাকতে হবেনা । আমার সাথে বাড়ি চল । ওখানে গিয়ে থাকবি”।
দাদার আশ্বাস পেয়ে সুমিত্রা নিজের চোখ মুছে কান্না থামায় । তারপর সরু গলায় বলে, “না দাদা । শুনেছি আমি এই শহর কাউকেই ফেরায় না । সবাই কেই কিছু না কিছু দেয় । হতে পারে আমার ক্ষেত্রে একটু দেরি হবে । কিন্তু আমার বিশ্বাস আমি পাবো । খালি হাতে যাবোনা”।
বোনের কথা শুনে বিচলিত হয়ে দীনবন্ধু বলে, “দেখ বোন । অনেক দেখলাম এই স্বার্থপর শহরটাকে । অনেক হয়েছে এবার দাদার কথা শোন । বাড়ি ফিরে চল । আর বরের ঘরেও ফিরতে হবেনা তোকে”।
চোখের জল মুছে, নাক টেনে আবার পাতলা গলায় বলে সুমিত্রা, “না দাদা আমি আর যাচ্ছিনা ওই শয়তান টার ঘরে । আমি এখানে রান্নার কাজ করে ছেলেকে নিয়ে থাকতে চাই”।
বোন রান্নার কাজ করবে সেটাও মেনে নিতে পারছে না দীনবন্ধু । গ্রামে ঘরে বসে বসে খাবে তবুও অন্যের বাড়িতে কাজ করতে দেবেনা আদরের বোনটাকে ।
সে বলে । থাকনা বোন । দাদার কথা একটি বার শোন মা । ফিরে চল তুই ।আজই ট্রেন ধরে গ্রামে ফিরে যাবো ।
দাদার জোর করা সত্ত্বেও নিজের স্থান থেকে অনড় সুমিত্রা ।সে বলে, “না দাদা । দেখি আর একটা বছর । যদি ভাগ্যের চাকা না ফেরে তাহলে আমি ফিরে যাবো । জানবো এই শহর আমাকে আপন করে নিতে পারেনি । আর তাছাড়া রান্নার কাজ পুন্নির কাজ । আমায় একটা বছর দাও । আমাকে আশীর্বাদ করো । যেন আমি সফল হই । আর তা নাহলে আমি ফিরে যাবো দাদা । আমি কথা দিলাম”।
বোনের কথা না মানলেও এর কোনো উপায় দেখতে পেলোনা দীনবন্ধু । সে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো ।
ওদিকে সুমিত্রা ভেজা চোখ নিয়ে ছেলের দিকে তাকায় । সঞ্জয় ও চাপা কান্না দমিয়ে রেখেছে । মায়ের সাথে চোখাচুখি হয়ে সেও বলতে চায় । আমি তোমার উপর অবিচার করেছি মা । পারলে আমায় ক্ষমা করো ।
সে সবকিছু বুঝতে পারছে।কিন্তু কিছু বলছে না ছেলেকে।এই মুহূর্তে।
নিজের চোখ সরিয়ে সুমিত্রা দাদাকে আর শ্যামল মিস্ত্রিকে আলাদা চেয়ারে বসতে দেয়। সে বলে, “ দাদা তুমি বস ,আমি খাবার বানিয়ে নিয়ে আসছি তোমাদের জন্য”।
বোনের কথা শোনার পর দীনবন্ধু উঠে দারায়।তারপর নিজের পুঁটুলি টা বোনকে এগিয়ে দেয়। বলে, “তোর বৌদি কিছু আতব চাল পাঠিয়েছে তোর জন্য । আর আখের গুড়”।
গ্রামের নিজের জন্ম ভিটের ফসল হাতে পেয়ে সুমিত্রা খুবই আপ্লুত। সে একমুঠো আতব চাল হাতে নিয়ে সেটাকে নাকের কাছে নিয়ে গিয়ে শুঁকতে থাকে। একটা আলাদায় অনুভূতি হয় তার।
চলবে……..