- 1,476
- 2,219
- 159
আমার গল্পের পাঠক সংখ্যা কম হয়।কারন আমি রেডিমেড গল্প লিখতে পারি না।তাই সেই কতিপয় পাঠকের জন্য লিখছি।যারা আমার গল্প পড়ছেন এবং পছন্দ করছেন তারা সঙ্গে আছেন সেরকম বার্তা মাঝে মাঝে দেবেন।এক ধনতান্ত্রিক শ্রেণী সমাজে এক নিম্নশ্রেণীর মানুষ উচ্চশ্রেণীর রমণীকে ভোগ করছে তা অনেকের পোষায় না।কিন্তু আমি সর্বদাই এই বিষয়ে লিখি।সমাজের আকছার ঘটে থাকা ভিন্ন শ্রেণীর মানুষের প্রেম,ভালবাসা,সঙ্গম নিয়ে।শ্রেণী ভেদাভেদ দূর হোক এই মহানুভবতা শুধু সাহিত্য,কবিতা নয়,মানুষের কামনা বাসনার গোপন গল্পগুলিতেও মিশে যাক।এ গল্পটি সুনীল গাঙ্গুলির সেরকমই একটি প্রাপ্তবয়স্ক গল্প ‘স্বর্গের নীচে মানুষ’ থেকে নেওয়া।আমি যতটা পারছি মূল গল্পভাবনা,কথাগুলি রেখে তার পরিবর্তন ঘটিয়ে অতন্ত্য মুক্ত যৌন গল্পে রূপান্তরিত করছি।
সামনে একটা নদী।এই নদী পার হতে হবে।পুরুষটির নাম রঞ্জন।তার বয়স ৩৫।স্বাস্থ্য সুঠাম।সে হালকা চকোলেট রঙের প্যান্ট আর সাদা শার্ট পরে আছে।সাদা শার্ট তার প্রিয়।কাঁধে ঝুলছে ক্যামেরা।
মেয়েটির নাম ভাস্বতী, বয়স ৩২,সে পরে আছে গাঢ় নীল রঙের শাড়ি ও ব্লাউজ–ব্লাউজের তলায় ব্রা’য়ের আউটলাইন চোখে পড়ে।তার ব্রা–র রং কালো,সায়ার রং কালো,পরে দেখা যাবে।তার ডাক নাম সতী।সবাই এই নামেই ডাকে।তার নাম ঝর্ণা হলেও বেশ মানাতো।সে খুব সুন্দরী,অল্পবয়সী বালকের মতন দুরন্ত।রূপহীনা মেয়েদের গল্প আলাদা,রূপসী মেয়েদের গল্প আলাদা।এটা রূপের গল্প।এরা দুজনে স্বামী-স্ত্রী।এদের দুজনের অনেক আলাদা গল্প আছে।যেমন অনেকেরই থাকে।
এক একদিন হয় না দুপুর বেলাতেই আকাশটা সন্ধ্যের মত আঁধার হয়ে আসে।এই দিনটাও সেই রকম।নৈঋত কোন থেকে আস্তে আস্তে সারা আকাশ ছেয়ে আছে মেঘে।তবে সেই মেঘ যেন পাথরের মতন শক্ত,বর্ষণের কোন চিহ্ন নেই।এই মেঘের পটভূমিকায় পাহাড়টাকে গম্ভীর মনে হয়।এইসব দিনে কেউ নদী পেরিয়ে পাহাড়ে ওঠার স্বাদ করে না,কিন্তু ভাস্বতী খুব জেদি।
পৌঁছতে খুব দেরি হয়ে গেল।সকাল থেকেই গাড়ী খারাপ।রঞ্জন বলেছিল আজ আর বেরুবো না।
ভাস্বতী বলেছিল সারাদিন ডাকবাংলোয় বসে থাকবো না।
রঞ্জন বলেছিল কিন্তু গাড়ী যে খারাপ।
ভাস্বতী বলেছিল মাত্র দুবছর আগেও আমাদের গাড়ি ছিল না।তখনও আমরা বেড়াতে বেরুতাম।সুতরাং রঞ্জন গিয়েছিল দেড় মাইল দূর থেকে গাড়ীর মিস্ত্রী ডেকে আনতে।মিস্ত্রী এসে ঠুকঠাক করে জানালো গাড়ী গ্যারেজে নিয়ে যেতে হবে।নিয়ে যাওয়া হল ঠেলতে ঠেলতে।রঞ্জন চেয়েছিল অনেকক্ষণ সময় লাগুক।মিস্ত্রী সম্প্রদায় জানালো গাড়ীর অনেক অসুখ,দুদিনের আগে সারবে না।
নিশ্চিতভাবে রঞ্জন ফিরে এসে বলল দুদিনের আগে কোথাও যাওয়া যাবে না।গাড়ী পাওয়া যাবে না।
ভাস্বতী বলল বাস রয়েছে।মানুষ বাসেও বেড়াতে যায়।নইলে বাসগুলো চলে কেন?
রঞ্জন বলল ভুল,বাসে লোকে কাজকর্মে যায়।বেড়াতে যায় না।তাছাড়া বাস নদীর ধার পর্যন্ত যায়।নদী থেকে তিন-চার মাইল দূর দিয়ে বাস যায়।এমন পাহাড়ী বুনো নদী অবধি কে’বা যাবে।
—হাঁটতে হবে বলে তুমি ভয় পাচ্ছো!
রঞ্জন ভীতু নয়।তার শরীরে শক্তি আছে।বুকে সাহস আছে।সে পৃথিবীর হেরে যাওয়া মানুষের দলে নয়।বরং সে অতিরিক্ত পেয়ে থাকে।সে সাঁতারে মেডেল পেয়েছে,কলেজে ক্রিকেট খেলেছে,ভূতে বিশ্বাস করে না।শহরের রাস্তায় হঠাৎ হৈচৈ শুরু হলে সে দৌড়তে শুরু করে না।দাঁড়িয়ে দু-এক দন্ড দ্যাখে।কিন্তু সে পাহাড়ে উঠতে ভালোবাসে না।ভালোবাসে না-ভালোবাসে না,এর কোনো যুক্তি নেই।মোটরগাড়ী শুদ্ধ তাকে পাহাড়ে তুলে দাও-সে বিখ্যাত সৌন্দর্য্যগুলি উপভোগ করবে।কিন্তু ওইসব সৌন্দর্য্যের লোভে সে হেঁটে পাহাড়চূড়ায় উঠবেনা।তবে সে পরিশ্রম বিমুখ নয়।সমুদ্রে সাঁতার কাটতে বলুক না কেউ রঞ্জন এককথায় রাজি।অনেক মানুষেরই এরকম অদ্ভুত একটি দুর্বলতা থাকে।
—-বিশেষত নদী পেরিয়ে পাহাড়টি দেখতে যাওয়া সম্পর্কে তার মনে অন্য একটি আপত্তি ছিল।পাহাড়টি সম্পর্কে একটি কুসংস্কার জড়িত।সে কুসংস্কারের প্রশ্রয় দিতে চায় না।ভাস্বতী যাবেই যাবে।এই ধরনের গল্প শুনলেই ভাস্বতী পরীক্ষা করে দেখতে চায়।হাতের কাছেই যখন রয়েছে।রঞ্জনের অভিমত হচ্ছে এইসব কুসংস্কার পরীক্ষার আগ্রহও একধরনের স্বীকার করে নেওয়া।
—-তুমি কুঁড়েমি করে যেতে চাইছোনা,তাই বলো!অত সব যুক্তি দেখাচ্ছো কেন?
রঞ্জন ট্রাউজার ও গেঞ্জি পরে বসেছিল ডাকবাংলোর বারান্দায়।তার চওড়া কব্জিতে বাঁধা ঘড়ির কাঁচে রোদ পড়ে ঝলসে উঠছে।তার সুঠাম স্বাস্থ্য,এই মানুষকে দেখে কেউ অলস বলবে না।
তবু রঞ্জন হেঁসে বলেছিল এক একদিন কুঁড়েমি করতেও মন্দ লাগেনা। এসো না আজ সারাদিন শুয়ে থাকি।
ভাস্বতী তার হাত টেনে ধরে বলেছিল না,ওঠো।
অতএব বেরিয়ে পড়তেই হয়।স্থানীয় লোকজন কেউ কেউ বলেছিল পাহাড়টাতে উঠতে তিনঘন্টা,নামতে তিনঘন্টা লাগে।আবার কেউ কেউ বলেছিল ও পাহাড়ে ওঠাই যায় না।দেখতে ছোট হলে কি হবে।আবার কেউ বলেছিল সুন্দর রাস্তা বানানো আছে,কোন অসুবিধে নেই।বনাঞ্চলের এই এক অসুবিধে শ’য়ে শ’য়ে পাহাড় অজানাই থেকে গেল।নির্জনতার দম্ভ নিয়ে তারা মাথা উঁচিয়ে থাকে।পাহাড় এবং জঙ্গলের পথ সম্পর্কে মানুষের নানারকম মত থাকে।যারা রাস্তা মাপে তারা ছাড়া কেউ সঠিক দূরত্ব আন্দাজ করতে পারে না।পাহাড় কারুর কাছে সবসময়েই দূরে,কেউ ভাবে যতই দূরে হোক যাওয়া যায়।তবে এই পাহাড়টির কথা একটু আলাদা।এরা পাহাড়টিকে ভক্তিও করে আবার ভয়ও করে।
রঞ্জন বিরক্ত হয়ে মন্তব্য করেছিল এদের কারোর কথা বিশ্বাস করা যায় না।কারোর সাথে কারোর মেলে না।
ভাস্বতী বলেছিল গিয়েই দেখলে বোঝা যাবে কোনটা সত্যি।
রঞ্জন সাহসী,ভাস্বতী দুঃসাহসীকা।অথবা,গোঁয়ার শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ।ঝরঝরে বাস,কিন্তু তার ফার্স্টক্লাস,সেকেন্ড ক্লাস,থার্ড ক্লাস আছে।
ভাস্বতীর ইচ্ছে থার্ড ক্লাসে আর সব নারী,পুরুষের সঙ্গে মিলে মিশে যায়।রঞ্জন তাতে সম্মতি জানায়,আপত্তি জানানো অর্থহীন বলে।বাসে উঠে এই ভিড়ভাটটায় রঞ্জনের ভালোলাগেনা।যাদের দেখলে বোঝা যায় পকেটে পয়সা আছে,শহুরে শিক্ষিত,সঙ্গে ফর্সা চেহারার রমণী থাকলে গেঁয়ো জঙ্গলাকীর্ণ লোকেরা একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে দ্যাখে।তবু ভালো রঞ্জন আর ভাস্বতীর ভাষা এখানে কেউ বোঝে না।ওড়িয়া কিংবা আদিবাসীদের এক ওড়িয়া মিশ্রিত নিজস্ব ভাষা চলে।সে ভাষা বোঝা দুস্কর।ওড়িশা।
দেড় ঘন্টার পথ তবু প্রায় তিনঘন্টা লেগেছিল।তবু ভাস্বতী বিরক্ত হয়নি সে উচ্ছলতায় রঞ্জনকে মাতিয়ে রেখেছিল।বেড়াতে এলে ভাস্বতী একটু বেশি উচ্ছল হয়ে ওঠে।মানুষ মুক্তিকামী। যতই তার জীবন আধুনিকতা, স্বাধীনতা থাক না কেন।তবু সে মুক্তি খোঁজে।ভাস্বতী ব্যতিক্রম নয়।কয়েকটা জনপদ পেরিয়ে গাড়িটা এগিয়ে ওদের যেখানে নামতে হয় সেখানে কয়েকটা খাবারের দোকান।খাঁটি অতন্ত্য বেশি গন্ধময় দুধে ভেজানো চা।কলকাতার চা’য়ের কোনো স্বাদ নেই তাতে।ওরা দু গেলাস চা নেয়।পরে আরো এক গেলাস।
এরপর মাইলের পর মাইল,প্রায় তিন মাইল হাঁটা পথ।ইতিমধ্যে মেঘ ঘনিয়ে আসে।দ্বিপ্রহরকে মনে হয় সায়াহ্ন।ঝলমলে বহিঃদৃশ্যকে অপ্রসন্ন মনে হয়।কোথাও পাখি নেই।ইতিউতি ফড়িং ওড়াউড়ি করছে।এরই মধ্যে মেঘ চিরে একটা বিমান উড়ে যায়।খুবই অবাস্তব মনে হয়।এমন ঘন অরণ্যে এই শব্দ বেমানান লাগে।পায়ের তলায় শাল পাতার খসখস নীরব শব্দ।লম্বা লম্বা মোটা গাছ এলোমেলো পাহাড়ে উঁচিয়ে আছে।
রঞ্জন বলল আজ আর যাওয়া উচিত নয়।আকশের অবস্থা একদম ভালো নয়।
ভাস্বতী বলল আমার একদম ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে না।
—-যদি অনেক রাত্তির হয়?
—-যেখানেই থাকি রাত্তিরতো হবেই।
ভাস্বতীর এই কথাটিকে কোনো যুক্তি বলা যায় না।কিন্তু মেয়েরা এমন অযৌক্তিক কথা বলে বলেই তো মোহময়ী।কেউ কেউ বলে রহস্যময়ী।রঞ্জনের মত যুক্তিবাদী মানুষও ভাস্বতীর এই কথা শুনে হাসলো।
নদীটি ছোট।হেঁটে পার হওয়া যায়।প্রতক্ষ্য প্রমান হিসেবে একটা গরুর গাড়ী পার হয়ে আসতে দেখা গেল।গরুর গাড়িটি পাহাড় থেকে আসেনি।নিশ্চিত ওপাশে কোনো লোকালয়ের রাস্তা আছে।
ভাস্বতীর কাঁধে ঝোলানো একটি চামড়ার ব্যাগ।তাতে টুকিটাকি ব্যবহার্য্য জিনিসপত্র।বেশি ভারী।রঞ্জনের কাঁধে শুধু ক্যামেরা।এতে যেন কেউ মনে না করে রঞ্জন তার স্ত্রীকে দিয়ে ভারী ব্যাগ বইয়ে নিচ্ছে।ভাস্বতী সুন্দরী ও আধুনিকা–সে সাধ্য কি রঞ্জনের?আসলে ব্যাগটা ওরা ভাগাভাগি করে নেবে বলেছিল।কিছুক্ষন আগে ভাস্বতীর অনুরোধে সেটা ভাস্বতী নিয়ে নিয়েছে।রঞ্জন ভাস্বতীর হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে নেয়।নদী পার হবার জন্য শাড়ি উচু করলো ভাস্বতী।রঞ্জনও গুটিয়ে নেয় ট্রাউজার্স।
নদীর জলে পা দিয়েই বোঝা গেল জল যেমন ঠান্ডা,তেমনই তীব্র স্রোত।পাহাড়ী ছোট নদীগুলো খুব তেজি হয়।এটা তেমনই একটা নদী।তার বুকের উপর দিয়ে হেঁটে যেতে পারো,কিন্তু তাকে সমীহ করতে হবে।
তবে এ নদী সাঁতার কাটার মত নয়।তবু জলে পা দিয়ে রঞ্জনের মেজাজ ভালো হয়ে যায়।
—-সতী আমার হাত ধরো।
ভাস্বতী বনভূমিতে বেড়াতে এলে সবকিছুতেই আনন্দ পায়।এই স্রোতের জল,স্রোত তার স্পৃহাকে আনন্দিত করে তোলে।একহাতে চটি,অন্য হাত রঞ্জনের বাহুতে।বড় বড় পাথরের টুকরো তার পায়ে খোঁচা দেয়।তবু সে হাসছে।হাসতে হাসতে বলে যদি কোন জায়গায় জল বেশি থাকে?
ভাস্বতী সাঁতার জানে না।তবে জল বেশি থাক বা না থাক ভাস্বতীর প্রশ্নে ভয়ের চিহ্ন নেই।এ সবই–কৌতুক।রঞ্জনের মুখ থেকে সে আশ্বাসবাণী শুনতে চায়।যা শুনিয়ে রঞ্জন পরিতৃপ্ত হবে।নির্ভরযোগ্যতাই প্রধান যোগ্যতা।রঞ্জন নির্ভরযোগ্য তার স্ত্রীর কাছে।সে পাহাড়ে হোক বা জলে।
ভাস্বতীর শাড়ি উঠেছে হাঁটু পর্যন্ত।ফর্সা পা দুটোকে ধুইয়ে জলের স্রোত বয়ে চলেছে।ক্রমশ জল বেড়ে চলেছে।এমন নির্জনতাই নারী পুরুষকে আনন্দ দেয়।স্বামী-স্ত্রীকেও।শয়নকক্ষে কেউ থাকে না—তবু এই আকাশের নীচে পাহাড় আর নদীর পটভূমিকায় দুজনে নিরালা হবার স্বাদ আলাদা।ভাস্বতী নিচু হয়ে এক আঁচলা জল ছিটিয়ে দেয় রঞ্জনের গায়ে।
রঞ্জন বিরক্ত হল না।স্রোতস্বিনী নদীতেও সে ঘুরে দাঁড়ালো ভাস্বতীর দিকে।ভাস্বতীর কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে হাসতে হাসতে বলল, ফেলে দিই ফেলে দিই?
কেউতো এখানে দেখার নেই।কেউ তো জানে না যে সে কলকাতার একটি বড় সংস্থার দায়িত্বপূর্ণ অফিসার! এখানে একটু ছেলেমানুষী করতে দোষ কি?
কেউ না দেখলেও কিছু কিছু ব্যাপার আসে যায়।ভাস্বতী তার শাড়ি উরুর অনেকখানি তুলে ফেলেছে।রঞ্জনের চোখ গেল সে দিকে।এবার তার দৃষ্টিতে অন্যধরনের হাসি।ভাস্বতীর ফর্সা উরু,নীল শাড়ি যেন যবনিকা।যে পুরুষ তার স্ত্রীকে শয়নকক্ষে নিরাবরণ দেখেছে।ঘুমের মধ্যে ওই উরুরু উপর হাত রেখেছে–অনুভূতিহীন হাত–বহু দিনের বেলা তার স্ত্রী যখন শাড়ি পাল্টেছে তার কাছাকাছি,হয়তো বা সে পড়েছে সেসময় কোনো অকিঞ্চিতকর বই—আজ সে সেই শরীরের আভাস পেয়ে রোমাঞ্চিত।এরকমও হয়।
জল আর একটু বাড়লো।ভাস্বতী আর শাড়ি তুলল না।সবটাই ফেলে দিল।ভিজে একাকার।এ অঞ্চলের আদিবাসী মেয়েরা শাড়ি নদীতে ভেজায় না।অনেক লোক থাকলেও তারা শাড়ি তুলে নেয়।কারন তাদের আর হয়তো শাড়ি নেই।এই মুহূর্তে ভাস্বতীর কাছেও কোন দ্বিতীয় শাড়ি নেই।তবুও সে ভেজালো।খানিকটা নিজের স্বামীর কাছেই লজ্জা পেয়ে।
ভাস্বতী সাধারণ সুন্দরী নন।প্রত্যেক সুন্দরীরও নিজস্ব খুঁত থাকে।হয়ত ভাস্বতীরও আছে।কিন্তু ভাস্বতীর বুদ্ধিমত্তা,দুঃসাহস,আনন্দউচ্ছলতা,মুক্তিকামী হৃদয় তার রূপসী ফর্সা তনুকে অতিরিক্ত রূপসী করে তুলেছে।সে যেন এই স্রোতস্বিনী নদীরই প্রতিরূপ।
ভিজে শাড়ি ঠেলে ঠেলে এগিয়ে যেতে সময় লাগে।ভাস্বতী এগিয়ে চলে।রঞ্জন জলের তল মেপে ধীরে ধীরে পিছনে এগোয়।
—-দ্যাখো,কি সুন্দর ছোট মাছ!
—-তাড়াতাড়ি এসো সতী!
—-তুমি মাছগুলো দেখছো না কেন?
—-তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে না?
—-এখনই পৌঁছলাম।এরই মধ্যে ফেরার কথা!
—-সাড়ে সাতটার পরে আর বাস নেই।এখানেই রাত কাটাতে হবে তাহলে।
—-দারুন হবে তাহলে।বেশ বনের মধ্যে—
সরু সরু ছাইরঙা মাছ জলের মধ্যে সুরুৎ সুরুৎ করে ঘুরছে।এই জলে কোথাও শ্যাওলা পাওয়া মুস্কিল।স্বচ্ছ জলের তলদেশে পাথর দেখা যায়।মাথার ওপর কয়েকটা ফড়িং ঘুরতে থাকে।
মাছ দেখার অতি উৎসাহ নিয়ে নিচু হতেই ভাস্বতী আর ভারসাম্য ঠিক রাখতে পারে না।জলের স্রোত তাকে টেনে নিয়ে যায় দূরে। ভয়মিশ্রিত হাসিতে চেঁচিয়ে ওঠে ভাস্বতী।
রঞ্জন দেখতে থাকে ভাস্বতীর জলে ভিজতে থাকার দৃশ্য।রঞ্জন চেয়েছিল জলে ঝাঁপ দিতে কিন্তু গলায় ক্যামেরা থাকায় অপেক্ষা করছিল।তাছাড়া স্রোত ক্রমাগত বাড়তে থাকলেও এখনো অগভীর।
ভাস্বতী ততক্ষনে উঠে দাঁড়িয়েছে।নীল শাড়িটা ভিজে লেপ্টে রয়েছে গায়ে।ভেজা শাড়িতে কোমল মসৃন পেট ও নাভি দৃশ্যত হেমেন মজুমদারের ছবি।কালো ব্লাউজে আবৃত নারীবক্ষ স্বচ্ছ হয়ে রয়েছে।
রঞ্জন ক্যামেরা নিয়ে দু-পা ছাড়িয়ে দাঁড়ায়।নিজের সুন্দরী স্ত্রীর এমন রূপমাধুরী দেখে লোভ সামলাতে পারে না কয়েকটা ছবি নেওয়ার।প্রথম ছবিতেই ভাস্বতী ভেঙচি কাটলো।দ্বিতীয় ছবিতে ভাস্বতী দু’হাত তার চুলে,মুখ ওপরের দিকে,মেঘের ছায়া পড়ে সেই মুখ পৌরানিক নারীর মতন।ভাস্বতীর শরীরে একটা শিহরণ বয়ে গেল।সেই মুহূর্তে,সেই বিশেষ মুহূর্তেই মনে হল তার: কি সুন্দর এই বেঁচে থাকা।
গহন অরণ্যে দশদিকব্যাপি নির্জনতার মধ্যে এক নদী,তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে সর্বাঙ্গ ভেজা নারী।এবং সেই দৃশ্যকে চিরস্থায়ী করে রাখছে রঞ্জন।
ওপাশে পৌঁছে রঞ্জন রুমাল খুলে ঘড়ি দেখলো।তিনটে দশ।গ্রীষ্মকালের দীর্ঘবেলা।রাত্রি নামার আগে অনেকটা সময় আছে।পাহাড়টি বিশেষ বড় নয়।অধিকাংশ ভারতীয় পাহাড়ের মত।এর চূড়ায়ও একটি মন্দির আছে।মন্দিরটি দূর থেকে দেখা যায়।অচেনা অজানা জনমানবশূন্য জায়গায় এরকম মন্দির দেখলে স্বস্তি লাগে।
চামড়ার ব্যাগে তোয়ালে ছিল।ভাস্বতী মাথা মুছলো,মুখ মুছলো।শাড়ি,ব্লাউজ সম্পুর্ন ভিজে গেছে।তার আর কিছু করার নেই।রঞ্জন চিন্তিত হলে ভাস্বতী বলে আমার কিছু হবে না।অত সহজে ঠান্ডা লাগবে না।
পাহাড়ী জঙ্গল যেমন হয়।ওড়িশার প্রত্যন্ত জঙ্গলে এরকম অজস্র পাহাড় থাকে।যা মানুষের চোখে অজানা।সরু একটা রাস্তা ঝোপের মধ্য দিয়ে উঠে গেছে বাঁ দিকে।সেটাই সম্ভবত ওঠার রাস্তা।একটা রাস্তা ডান দিকে ঝোপের মধ্যে মিলিয়ে গেছে।তার গতি ঢাল বেয়ে নিচু।ওটা হয়তো কোনো দিকে সমতলে গেছে।
ওঠার রাস্তাটি সরু হলেও দুর্গম নয়।বহু ব্যাবহারের চিহ্ন আছে।তবে বোঝা যায় অনেককাল কেউ ওঠে না।একটু খানি উঠেই ঢুকে গেছে বনের মধ্যে।
ঝোপ ঝাড় তবে খুব বেশি নয়।প্রত্যেকটা গাছকে একে ওপরের থেকে আলাদা চিহ্ণিত করা যায়।এসব বনে অনেক আগেই বন্যপ্রাণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।বাঘ এখানে কেবল উপকথার মত প্রাচীন বুড়োদের অভিজ্ঞতার গল্পে। ছোটখাটো কিছু প্রাণীর উপদ্রব থাকলেও ভয় নেই।রঞ্জন সশস্ত্র।তার লাইসেন্স পিস্তল আছে।
সিগারেট ধরিয়ে রঞ্জন বলল একটা গাইড-টাইড নিয়ে এলে হত।
ভাস্বতী মোহময়ী গলায় বলল এখন আর কেউ থাকলে আমার ভালো লাগতো না।
—-যদি রাস্তা হারিয়ে ফেলি?
—-একটাই তো রাস্তা দেখতে পাচ্ছি।
মন্থর পদযাত্রায় ওরা এগিয়ে যায়।এসেই যখন গেছে এখন দ্বিধা না রেখে উপভোগ করা শ্রেয়।
—-তুমি আসতে চাইছিলে না।জায়গাটা কি সুন্দর বলোতো।
—-হ্যাঁ,বেশ ভালোই জায়গাটা।
—-আমাদের এখানে যদি কেউ নির্বাসন দিত তো বেশ হত! আমরা সারাজীবন এখানেই থেকে যেতাম।
—-কতদিন?
—-আমি সারাজীবনই থাকতে পারি।
—-সত্যি পারবে?বাথরুম?
ভাস্বতী লজ্জা পেল।বিছানার বদলে মাটিতে শুতে দিক তার আপত্তি নেই।খাবার জুটুক না জুটুক তাতেও আপত্তি নেই।কিন্তু পরিচ্ছন্ন বাথরুম থাকা চাই।ঝকঝকে বাথরুম না পেলে তার মেজাজ খারাপ হয়ে যাবে।যতবার বেড়াতে গেছে,ভাস্বতী প্রথম ডাকবাংলোয় শোবার ঘরের বদলে বাথরুম পরীক্ষা করেছে।নোংরা ডাকবাংলোর জন্য নির্দিষ্ট ডাকবাংলো ছেড়ে এইবারে সাতাশ মাইল দূরের বাংলোতে আসতে হয়েছে রঞ্জনকে।
ভাস্বতী এখন তার চারিত্রিক দুর্বলতা গোপন করে বলল।তবু থাকতে পারবো।এখানে তো নোংরাই নেই।বেশ একটা কুঁড়েঘর বানিয়ে থাকতাম দু’জনে।
—-তারপর কুঁড়ে ঘরের সামনে একটা সোনার হরিণ আসতো।তুমি সেটা ধরে আনবার জন্য আবদার করতে আমার কাছে।
ভাস্বতী হেসে ওঠে।নিজের স্ত্রী’র কাছে এমন একটা চতুর শব্দ বলে রঞ্জন বেশ খুশি হয়।
রাস্তার পাশে পড়ে আছে একটা সিগারেটের প্যাকেট ও ইংরিজি খবরের কাগজ দোমড়ানো ভাবে।দুটোই খুব দূরের জিনিস বোঝা যায়।কৌতুহল বশতঃ রঞ্জন কাগজটির তারিখ লক্ষ্য করলো।দেড় মাসের পুরোনো।
একটা শাল গাছে ঠেস দিয়ে দাঁড়ালো রঞ্জন।সিগারেট ধরিয়ে বলল তুমি কি বিশ্রাম নেবে সতী?
—-আমি তো হাঁপিয়ে যাইনি।
—-পাহাড়ে উঠতে হয় খুব আস্তে আস্তে।প্রথমদিকে তাড়াহুড়ো করলে খুব কষ্ট হয়।
—-আমি পরেশনাথ পাহাড়ে উঠেছি।আমারতো কষ্ট হয়নি।তোমার কি হচ্ছে?
মিনিট চল্লিশেক বাদেই মনে হল তারা পাহাড়টার এক-তৃতীয়াংশ উঠে এসেছে।রঞ্জন তৃপ্ত হল।এই গতিতে গেলে তাড়াতাড়ি ফেরা যাবে।নামার সময় কমসময় লাগে।
এখান থেকে নদীটাকে অনেক নীচে মনে হয়।বনের আড়াল থেকে বোঝা যায় নদীর জলের তরঙ্গ।নদীর জলটা ভীষন কালো কুচকুচে মনে হয়।একটু আগেই তারা এ নদী পার করে এসেছে।ভীষণ নীল আর স্বাদু এ নদীর জল।
এমন বদলে গেল কি করে?
আসলে আকাশটা বদলে গেছে অনেকখানি।নীল আকাশ ঢেকে গেছে কালো মেঘে।নদীর রংও বদলে গেছে।রঞ্জন একটা পাথর তুলে নদীর জলে ছুঁড়ে ফেলবার চেষ্টা করলো।নদী অবধি পৌছালো না।
এই সময় ঝড় উঠলো।এবং সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টি।পাহাড়ী জঙ্গলের ঝড়বৃষ্টি খুব তীব্র হয়।বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা তীরের মতন বিঁধছে পাথরে।গাছগুলোর মাথা ঝটপট করছে বৃষ্টি আর মন্দ বাতাসে।
ওরা ছুটে গিয়ে একটা ঝাঁকড়া সেগুনগাছের তলায় দাঁড়ালো।প্রথম প্রথম জল লাগেনা।একটু পরে বৃষ্টির চেয়েও বড় বড় ফোঁটা ওদের ভিজিয়ে দেয়।রঞ্জন ক্যামেরাটা বাঁচাতে তড়িঘড়ি ব্যাগে ভরে নিল।আকাশ একেবারে ফেটে পড়েছে ভারী বৃষ্টিতে।পাহাড়ী রাস্তাটা এখন ঝর্নার মত।
ওদের ভ্রু কুঁচকে আসে।অল্প অল্প শীতের মতন হয়।এত অসম্ভব ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে বিপদের গন্ধ আসে।অচেনা নির্জন অরণ্যে এরকম ঝড়বৃষ্টি ভয়ের কারণ।
কিন্তু বিপদ আসেনি।ওরা দু’জন ভয়কে আচ্ছন্ন করার সুযোগ দেয় না।পরস্পরের দিকে হাসি বিনিময় করে।
রঞ্জন ভাস্বতীকে কাছে টেনে নেয়।ভাস্বতীকে বৃষ্টিতে সিক্ত অবস্থায় দেখে নিজের প্রণায়াবেগ চেপে রাখতে পারে না রঞ্জন।এমন বিপদের দিনে সুন্দরী স্ত্রীকে কাছে পেলে যেকোনো পুরুষই ঘনকামনায় বিভোর হবে।মিষ্টিমুখের মৃদু হাসিতে ভাস্বতীর ঠোঁটখানা কাঁপতে থাকে।ভাস্বতী রঞ্জনের পাঁচ বছরের পুরোনো স্ত্রী।এমন সুন্দরী,দুঃসাহসী,বুদ্ধিমতী স্ত্রী কি কখনো পুরোনো হয়? রঞ্জন ভাস্বতীর কোমল শরীরটাকে জড়িয়ে উষ্ণতা বিনিময়ের চেষ্টা করে।ঠোঁটের পাঁপড়ি দুটোকে নিজের ঠোঁটে চেপে ধরে।গাছের পাতা বেয়ে তখন প্রকৃতি যেন স্নানঘরের শাওয়ার।ঠোঁট দুটো মিশে ঘন চুম্বনে মেতে রয়েছে।স্বামী-স্ত্রীর একান্ত প্রেমময় স্থান নারী-পুরুষের ঠোঁট।চুম্বনের কয়েকটি মুহূর্ত দুজনের জীবন থেকে বিপদের অস্বস্তি মুছে যায়।রঞ্জন যেন গভীর চুম্বনে তার স্ত্রীকে আশ্বস্ত করছে।ভাস্বতী নিজের শরীরটাকে রঞ্জনের শরীরে আরো গভীর ভাবে মিশিয়ে দেয়।নরম বুকদুটো রঞ্জনের বুকে চেপে ধরে দীর্ঘস্থায়ী চুম্বন চলতে থাকে।
তারপর ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় দুজনের।পরস্পরের দিকে উজ্জ্বল দৃষ্টিতে তাকায় দুজনে।অঝোর বৃষ্টির ধারা ওদের দু’জনের মাথা গড়িয়ে পড়ছে।কড়কড় শব্দে হঠাৎ প্রচন্ড বজ্রপাত হয়।
রঞ্জন বলল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা বোধ হয় ঠিক নয়।দাম্পত্যের রোমান্সে এই বজ্রপাত যেন হিংস্রতার ছাপ রাখে–তৃতীয় অনাকাঙ্খিত ব্যক্তির মত।
রঞ্জন এদিক ওদিক তাকাতে থাকলো।গাছের তলা ছেড়ে বা কোথায়ই যাবে!
গাছগুলো থেকে ঝরে পড়ছিল প্রচুর শুকনো পাতা।কোথাও গাছের ডাল মড়মড় করে ভেঙে পড়ার শব্দ হচ্ছে।যে কোনো গাছ ভেঙে পড়বার সম্ভাবনা আছে কিংবা বজ্রপাত।
রঞ্জন ভাস্বতীর হাতটা ধরে বলল চলো,এখানে আর দাঁড়ানো যাবে না।
ছুটে গিয়ে দাঁড়ালো বড় একটা পাথরের কাছে।এখানে বেশি ভিজতে হবে কিন্তু গাছ ভেঙে পড়বার ভয় থাকবে না।
বৃষ্টি একটুও কমেনি।বরং বেড়েই চলেছে।
ভাস্বতী ক্ষুণ্ন গলায় বলল আমরা যাতে পাহাড়টায় না উঠতে পারি তার জন্য একটার পর একটা বাধা আসছে।লোকেরা এইজন্যই আমাদের এখানে আসতে বারণ করেছিল।
রঞ্জন ভাস্বতীর গালে টোকা মারলো।এসব কি বলছো কি?
—-যাইহোক না কেন আমরা ওই পাহাড়ে উঠবোই।
রঞ্জন বলল নিশ্চই উঠবো।তবে আজ বোধ হয় ফিরে যেতে হবে।সাড়ে চারটে বেজে গেল।আর বেশি দেরি করলে ফেরার উপায় থাকবে না।কাল আবার না হয় আসা যাবে।
ভাস্বতী তীক্ষ্ণ ভাবে জিজ্ঞেস করলো কাল ঠিক আসবে?
—-কেন আসবো না।এবার রেনকোট আনা হয়নি।এই যা মুশকিল।
একটা রোমান্টিক অভিলাষ ছিল।এই ঝড় বৃষ্টি কাদায় তা পুরোপুরি উবে গেছে।তবে কাল আবার ফিরে আসতে হবে।একবার যখন সে এই পাহাড়ের চূড়ায় উঠবে ঠিক করেছে,সে উঠবেই।দরকার হলে বারবার ফিরে আসবে।
বৃষ্টি থামবার কোনো লক্ষণ নেই।ব্যাঙের সম্মিলিত ডাক শুরু হয়েছে।
রঞ্জন তক্ষুনি ফেরার পথ ধরতে চায়।এই বৃষ্টিতে পাথরগুলো অত্যন্ত পিচ্ছিল।সেগুলিকে ভয়ঙ্কর বলা যেতে পারে।তবু সে ভাস্বতীর হাত ধরে বলল সাবধানে নামতে পারবে?
—-সে ম্লান গলায় বলল পারবো, ফিরে চলো।
কয়েক পা এগিয়েই রঞ্জন বুঝতে পারলো এটা হঠকারিতা।এরকম প্রকৃতির ভয়ঙ্কর রূপের সাথে প্রতিযোগীতা করার কোন মানে হয় না।
এত ঝড়বৃষ্টির মধ্যে পাহাড়ী ঢালু রাস্তায় কেউ পথ হাঁটে না।স্থানীয় আদিবাসীরা তো বৃষ্টিতে বনাঞ্চলে পা’ই বাড়ায় না।
হঠাৎই রঞ্জনের মনে হল পাশে একটা সরু জিনিস নড়াচড়া করছে।কেঁচো হতে পারে।কিংবা জোঁকও হতে পারে।রঞ্জন বুঝতে পারে বৃষ্টির সময় অরণ্যের এই সব প্রাণী দেখা মেলা নিশ্চিত।তারওপরে গোখরোর উপদ্রব পাহাড়ে বেশিই।
রঞ্জনের জুতোর মধ্যে ভিজে মোজা পরে হাঁটতে অস্বস্তি হচ্ছিল।জুতোখুলে মোজা খুলে নিল সে।ভাস্বতী নীচের দিকে শাড়ি,সায়া খানিকটা চিপড়ে নিল।ওরা এত ভিজেছে গা,মাথা মোছার কোনো মানে হয় না।
বৃষ্টিতে অরণ্য আরো বেশি নিঃঝুম হয়ে পড়েছে।ফেরার জন্য ওরা তৈরী হয়েছে এমন সময় সোনা গেল মনুষ্যকন্ঠ।একটা গানের মত আওয়াজ কথা শোনা যায় না,শুধু সুর—কণ্ঠস্বর খুব সুরেলা নয়—বেসুরোরা যেভাবে গান গায়,সেরকমই।
ওরা দু’জনে চোখ চাওয়াচাওয়ি করলো।কিন্তু কোনো কথা বলল না।
সুরটা শোনা যাচ্ছে।ক্রমশ পাহাড় থেকে এগিয়ে আসছে।জঙ্গল ভেদ করে।
একটু বাদেই পাথরের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো একটা মনুষ্য মুর্তি।
ক্রমাগত বৃষ্টির মধ্য দিয়ে এগিয়ে আসছে বিরাট লম্বা চওড়া লোকটা।
লোকটার পরনে হাঁটুর নীচ অবধি ধুসর কালচে রেইনকোট।মাথায় টুপি কপাল পর্যন্ত ঢাকা,পায়ে ভারী গামবুট।তার হাতে একটা লম্বা লোহার জিনিস,দেখলে মনে হয় একটা খুব বড় সাইজের চিমটে,সেটা দিয়ে সে ঝোপঝাড়ে আঘাত করতে করতে আসছে।আর আপনমনে গান গাইছে।কথা না বোঝা গেলেও গানের সুরটা চিনতে পারলো ভাস্বতী।এই পরিবেশে এরকম গান শোনা যায়!—‘যেদিন সুনীল জলধি হইতে উঠিল ভারতবর্ষ/সেদিন বিশ্বে সে কি কলরব,সেকি হর্ষ,সে কি মা ভক্তি…’
লোকটি প্রথমে দেখতে পায়নি ওদের।তারপর চোখ তুলে তাকালো।এগিয়ে আসলো ওদের দিকে।আপাদমস্তক ভালো করে দেখলো গম্ভীর ভাবে।ভাস্বতীর দিকেই তার বেশিক্ষণ দৃষ্টি,বলাই বাহুল্য।
লোকটির এমন ভাব,যেন সে অরণ্যের অধিপতি।যেন তার এলাকায় আগুন্তুক এসেছে।গম্ভীর ভাবে খুঁটিয়ে দেখছে সে।
গম্ভীর ভাবে বলল বাঙালি?
রঞ্জন বলল হ্যাঁ
—-বৃষ্টিতে আটকে পড়েছেন?
—-হ্যাঁ
—-ফিরে যাবেন?
—-তাই ভাবছি।
কথা বলার সময় লোকটি মাটিতে লোহার চিমটেটা ঠুকছিল।শব্দ হচ্ছিল কর্কশ ভাবে ঠন ঠন ঠন।
রঞ্জনের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল বছরের এই সময়টা খুবই খারাপ।
ভাস্বতীর দিকে তাকিয়ে বলল আপনি নিশ্চই উপরের মন্দিরটায় যেতে চাইছিলেন?
ভাস্বতীর বদলে রঞ্জনই উত্তর দিল সেরকমই ইচ্ছে ছিল।এখন আর হবে না।
লোকটি হাসলো যেন সে হঠাৎ কোনো পুরোনো ঘটনা মনে করে ফেলেছে।
বৃষ্টি থেমে গেলেও আকাশের রং ময়লা।অন্ধকার হয়ে রয়েছে চারপাশ।এইটুকু বোঝা যাচ্ছে যে আজ আর বিকেলের আলো ফুটবে না।
মাথার টুপিটা খুলতেই লোকটির মুখ এতক্ষনে দেখা গেল।বয়স অনুমান করা মুস্কিল চল্লিশের বেশি হলেও হতে পারে আবার পঞ্চাশও হতে পারে।একমাথা ঝাঁকড়া চুল,অবিন্যস্ত।খাড়া নাক,রোদে পোড়া তামাটে রঙ।তীক্ষ্ণ ঝাঁঝালো চোখ।কথা বলার ধরণও ভারিক্কি ধরণের।
—-আপনারা কোথা থেকে আসছেন?
—-কলকাতা থেকে।
লোকটি আবার হাসলো।যেন মনে হয় মুখে একরকম কথা বলে মনে অন্যকিছু ভাবে।
বলল কলকাতা অনেক দূর।এখন কোথা থেকে আসছেন?
রঞ্জন ডাকবাংলোটার নাম বলল।
লোকটাকে এবার চিন্তিত দেখালো।মাটিতে চিমটেটা গেঁথে দিয়ে টুপিটা পরিয়ে দিল।
ভাস্বতী এই প্রথম কথা বলল আপনি কোথায় থাকেন? কাছাকাছি?
লোকটি যেন চমকে উঠলো ভাস্বতীর গলার আওয়াজ শুনে।ভাস্বতীর মুখ ও ভিজে শরীরের দিকে তাকিয়ে থেকে আস্তে আস্তে বলল এই পাহাড়েই আমার ঘর।
রঞ্জন আর ভাস্বতী দু’জনেই অবাক হল।এই পাহাড়েই ঘর মানে!মন্দিরের পুরোহিত?না তো দেখে তো মনে হয় না।পরনের পোষাক ও রূপে এক বন্য আদিমতার ছাপ আছে।কিন্তু পাহাড়ে যারা থাকা তাদের পাহাড়ী বলে একে কি বলা যায়?
লোকটি পকেট থেকে সিগারেট বের করলো।কি মনে করে নিজে ধরানোর পর রঞ্জনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল চলবে?
রঞ্জনের সিগারেটের প্যাকেট বৃষ্টিতে ভিজে গেছে।সিগারেট পেয়ে সে কৃতজ্ঞতা বোধ করলো।বলল ধন্যবাদ।আমাদের সাড়ে সাতটার মধ্যে বাস ধরতে হবে।
—-তার আগে নদী পার হতে হবে।
—-হ্যাঁ আচ্ছা চলি।
—-কোথায় যাবেন?
—-নদীর দিকে।
রঞ্জন চামড়ার ব্যাগটা তুলে নিয়ে ভাস্বতীকে বলল চলো।
লোকটির সাথে তাদের পরিচয় হয়নি,নাম জানাজানি হয়নি।তাই আনুষ্ঠানিক বিদায় নেবার প্রশ্ন ওঠে না।অনেক দূরে বাঙালি দেখা হলে যে উচ্ছাস দেখানোর রীতি আছে তা রঞ্জন আর ভাস্বতী মানে না।তবে লোকটির কাছ থেকে রঞ্জন সিগারেট নিয়েছে বলে বলল আচ্ছা চলি তা হলে।
ভাস্বতীও লোকটির দিকে তাকায়।লোকটি ভাস্বতীর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে।যেন ভাস্বতীর রূপের ছটাকে গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।এতে ভাস্বতী বিরক্ত হয় না।একজন সুন্দরী নারীর এই বিষয়ে অভ্যেস আছে।
লোকটি হাত তুলে বলল আপনাদের আজ ফেরা হবে না।
রঞ্জন লোকটির দিকে তাকালো বলল কেন?
—-ঐ নদী পেরুতে পারবেন না।
—-আসবার সময় পেরিয়ে এসেছি।
লোকটি এবার শব্দ করে হাসলো।সেই হাসির শব্দ জঙ্গলে প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো।ভরাট গলার গমগম করতে থাকা হাসিটা মোটেই ভাস্বতীর ভালো লাগলো না।
লোকটি বলল আসা আর যাওয়া কি এক কথা?এসেই কি যাওয়া যায় সবসময়?
রঞ্জন সোজা কথার মানুষ।এই ধরণের হেঁয়ালি সে ঘৃণা করে।কোনো উত্তর না দিয়ে সে ভাস্বতীকে বলল চলো।
ভাস্বতী লোকটির কাছ থেকে পুনশ্চ বিদায় নেবার জন্য ভদ্রতাসূচকভাবে বলল আমরা আবার কাল কি পরশু আসবো।
রঞ্জন বলল ঠিক নেই।যদি সুযোগ সুবিধে হয়—
লোকটি বলল কালকের কথা কালকে।আজকের কথা ভাবুন।একটা শব্দ শুনতে পাচ্ছেন।
একটু কান পাতলেই ওরা শুনতে পেল ঝড়ো কলকল জলের শব্দ।
ভাস্বতী বলল এদিকে কি কোথাও জলপ্রপাত আছে?
—-নদীর শব্দ।আসবার সময় এরকম শব্দ শুনেছি।
রঞ্জনের কথার জবাবে একটু উগ্র ভাবেই লোকটি বলল না আসবার সময় এরকম শব্দ শুনতে পাননি।এতদূর থেকে নদীর শব্দ পাননি।
রঞ্জন বুঝতে পারে সত্যটা।
—-এরকম পাহাড়ী নদী বৃষ্টিতে ভরে যায়।কিন্তু এমন শব্দ!
লোকটা ভারিক্কি গলায় বলে ওঠে ও নদী এখন পার হতে পারবেন না।
রঞ্জন সাঁতার চ্যাম্পিয়ন।সে জলকে ভয় পায় না।ভাস্বতী সাঁতার জানে না সেকথা তখন তার মনে পড়ে না।একটু অবজ্ঞার সুরে বলে উঠল ও জল যতই বাড়ুক কিন্তু পার হওয়া যাবে না কেন?লোকে কি ভাবে পার হয়?
—-লোকে পার হয় না।
—-এখন দু’তিন দিন কেউ পার হতে পারবে না।এসব নদীতে নৌকাও চলে না।
রঞ্জন কিছু বলতে যাচ্ছিল, লোকটি বাধা দিয়ে বলল সাঁতার জানলে কিছু হবে না।স্রোতের টানে তিন চার মাইল দূরে গিয়ে উঠবেন।যদি পাথরে ঘা না লেগে মাথা না ফাটে।
—-গিয়েই দেখা যাক।
লোকটার কথা ভদ্র লোকের মত হলেও চেহারার বন্যতার মত সবসময় একটা আদিম ঔদ্ধত্য আছে।
একটু যেন নরম হল লোকটা।বলল আমি এ জায়গায় অনেকদিন আছি তো তাই আমি জানি।তাছাড়া আপনি ওই নদীটার নাম জানেন?
—-খাবারের দোকান দার বলেছিল বটে নামটা। কি যেন জিরে না কি যেন।নাম দিয়ে কি হবে?
—-নদীর নাম সবসময়ে জেনে রাখা জরুরী।
—কেন?
—-স্থানীয়র এই নদীর নামটাকে জিরুয়া বলে।আসল নাম জিরা।
—-জিরা অতি সাধারণ বাঙালি মশলা।কিন্তু জিরা ঝাঁঝালো হয়।জিরা নদী একবার পেরোলে কি আর ফেরা যায়?
নিজের রসিকিতায় লোকটি আবার হাসলো লঘু ভাবে।ভাস্বতীর ঠোঁটেও একটা হাসির রেখা দেখা গেল।এই অদ্ভুত ধরনের লোকটাকে তার খারাপ লাগছে না।সাধারণত অচেনা লোকদের পছন্দ করে না সে।সকলেরই কথা একঘেয়েমি বস্তাপচা হয়।সত্যিই এর নাম জিরা নাকি লোকেরা নদীটার নাম জিরা দিয়েছে নাকি এই বন্য’টার বানানো?
—-আপনি কে?
—-আমি জিরার ওপারের হলেও একজন সাধারণ মানুষ।
এই কথাটা বলার সময় তার মুখে একটা সুক্ষ হাসি ফুটে ওঠে।যেন সে এই সাধারণ মানুষ কথা দুটোতে বেশি জোর দিচ্ছে—এবং সে যেন দু’জন অসাধারন মানুষের সাথে কথা বলছে।
রঞ্জন ভ্রু কুঞ্চিত করলো।লোকটি বেশি বেশি হেঁয়ালি করছে।বৃষ্টির পরে এরকম বিপদসংকুল পরিস্থিতিতে হাসির কথা মানায় না।
ভাস্বতী জিজ্ঞেস করলো আপনি এখানে থাকেন বললেন, আপনি এখানে কি করেন?
লোকটি সংক্ষিপ্তভাবে বলল ব্যবসা করি।
তারপর ও আরো বিস্তারিত ভাবে বলল দেখুন না এই পাহাড়,জঙ্গলে আপনার মত কোনো মহিলার গলার আওয়াজ শোনা যায়নি।এই গাছগুলো,পাথরগুলো পর্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে আপনার কথা শুনছে।
ভাস্বতী গাছপালাগুলোর দিকে তাকালো।যেন সে ভক্তদের দেখছে।তার ভালো লাগে।
রঞ্জন বিরক্ত বোধ করলো।আজেবাজে কথা শুনে সে সময় নষ্ট করতে চায় না।লোকটির কাছে আরো কিছু জেনে নেওয়ার পর বলল নদী যদি পার না হওয়া যায় তবে এদিকে আর কোথাও থাকবার জায়গা নেই?
লোকটি সবজান্তার মত হাসলো।
—-খোঁজ খবর না করে আপনাদের আশা ঠিক হয়নি।বৃষ্টির সময়ে এদিকে কেউ আসেনা।আদিবাসীদের গ্রাম এখান থেকে ছয়-সাত মাইল দূরে।সেও নদী পেরিয়ে যেতে হয়।
—-কেউ কেউ আমাদের আসতে বারণ করেছিল।
—-কিন্তু আপনারা বিশ্বাস করেননি কেন? অশিক্ষিত গেঁয়ো লোকের কথা বিশ্বাস করা যায়না?কিন্তু তারাই প্রকৃতিকে সবচেয়ে বেশি জানে।
রঞ্জন বলল একটা ছোট নদী পার হওয়া তেমন কিছু কঠিন কাজ নয়।
—-কিন্তু এই বিশেষ নদীটি পার হওয়া শক্ত।
ভাস্বতী একটু রেগে গিয়ে বলল তাহলে কি এই নদী বৃষ্টিতে কেউ পারাপার করে না?
—-ভারতবর্ষে ক’টা নদীতে ব্রিজ আছে বলুন?
—-কোনো খেয়া পারাপার?
—-এরকম পাহাড়ী নদীতে খেয়াপারাপার করা যায় না।তাছড়া এই পাহাড়টিতে লোকে আসতে চায় না।
রঞ্জনকে চিন্তিত দেখাচ্ছিল।ভাস্বতী বলল ওপরের মন্দিরটায় লোকজন আছে?
—-কেউ নেই।
—-তাহলে মন্দিরটা আছে কেন?
—-এরকম থাকে
—-তাহলে আপনি কোথায় থাকেন?
—-মন্দিরে থাকি না।
ভাস্বতী রঞ্জনের দিকে তাকিয়ে বলল মন্দিরটা যদি খালি থাকে তাহলে আমরা রাত্তিরটা ওখানে কাটাতে পারি।
ভাস্বতীর মনে এডভেঞ্চার স্পৃহা জেগে উঠেছে।বাথরুমের ব্যাপার মনে নেই, কিন্তু জোঁক! তারা কি এত উপরে উঠবে।
রঞ্জন বলল এখানে জোঁক কিলবিল করছে।
লোকটি বলল এগুলো জোঁক নয়,কেঁচো।তবে সাপ প্রচুর আছে।
তবে সাপের নাম শুনলে অন্য কোনো মহিলা লাফিয়ে উঠতো।কিন্তু ভাস্বতীর মনে হল পাহাড়ী জঙ্গলে সাপ থাকবে তাতে আর আশ্চর্য্য কি!
—-চলো আমরা মন্দিরের দিকে যাই।
লোকটি বলল মন্দিরে এসময় ওঠা সম্ভব নয়।বৃষ্টির পর পাথর পিচ্ছল হয়ে আছে।
ভাস্বতী বলল ওঠা যায়নাতো ওপরে মন্দির বানালো কি করে?
—-ওঠা যায় না তো বলিনি।এমনিতেই শক্ত, এই বৃষ্টিতে একেবারেই ওঠা যায় না।
রঞ্জন মাঝপথে ওদের কথা থামিয়ে বলল সতী চলো তো আমরা ঠিক নদী পার হতে পারবো।
রঞ্জন হাঁটতে শুরু করলো।ভাস্বতী চলে এলো তার পাশাপাশি।লোকটিকে কিছু না বলা হলেও পাশাপাশি হাঁটতে লাগলো।মাথায় টুপিটা পরে নিয়ে চিমটে দিয়ে ঝোপঝাড়ে পেটাতে থাকলো।এমন ভাবে চলছে সে যেন তার নিজের কাজেই চলছে।
রঞ্জন একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো।চেহারাটা ভীষণ দীর্ঘ—লোকটির কোনো বদ মতলব নেই তো?এই পাহাড়ে একা একা একটি বাঙালি লোকের থাকা কেন?কিসের ব্যবসা?অবশ্য চেহারায় যা হোক ওর কথাবার্তায় একটা ভদ্রতার স্পর্শ আছে।
টগবগে ছল ছল করছে নদীর জল।কে বলবে এই নদী সেই–যে নদী একটু আগে রঞ্জন আর ভাস্বতী পার হয়ে এসেছে!অন্ধকার নেমে এসেছে,কোনো জনপ্রাণীর চিহ্ন নেই।
ভাস্বতী রঞ্জনের বাহু আঁকড়ে আছে।
রঞ্জন বলল তুমি আমাকে শক্ত করে ধরে আঁকড়ে থাকতে পারো।রিস্ক নিতে পারবে তো?
ভাস্বতী নিজে ঝুঁকি স্বভাবের মেয়ে।এডভেঞ্চার তাকে আকর্ষণ করে।ভয় পাওয়া তার চরিত্রে মানায় না।কিন্তু সাঁতার জানে না।তার রক্ত মাংস চামড়ার মত ভয় বাস্তব।এই ভয়ের কাছে সবাই একা।অতন্ত্য প্রিয়জনের পাশে থাকাও—সান্ত্বনা দেয় না।
লোকটি অল্প দূরে দাঁড়িয়ে আছে।তার মুখে অল্প অল্প হাসি।সম্প্রতি সে একটা গাছের ডাল ভেঙে নিল।ডালাপালা সমেত ছুড়ে দিল জলে।
মুহূর্তেই নদীটা গ্রাস করে নিল সেটাকে।আবার কিছুক্ষন পরে অনেকদূরে ভেসে উঠলো সেটা।স্রোতের টানে চলে যাচ্ছে দিশাহীন ভাবে।তারপর আর সেটাকে দেখা গেল না।ভাস্বতী এবার শিউরে উঠলো।
রঞ্জন হাতের ব্যাগটা নামিয়ে রেখে এক এক করে পোষাক খুলে ভাস্বতীর হাতে দিয়ে জাঙ্গিয়া পরা অবস্থায় নেমে পড়লো জলে।
কোমর জল পর্যন্ত নেমেই রঞ্জনের দুঃসাহস ডালটার মত অবস্থায় পরিণত হল।
ভাস্বতী চেঁচিয়ে উঠলো,এই—-।
লোকটি ক্ষিপ্র পায়ে দৌড়ে গেল।চিমটেটা বাড়িয়ে দিল।ধমকের সুরে বলে উঠলো করছেন কি—পাগলের মতন।
অনেক চেষ্টার পর চিমটেটা ধরে রঞ্জন উঠতে পারলো।বিপদে পড়লেও রঞ্জন ভয় পায়নি।কিছু দূর গিয়ে সে ভেসে উঠতোই।
ভাস্বতীর মুখখানা রক্তিম।মনে মনে সে অসহায় হয়ে পড়েছিল।অল্পক্ষনের জন্য রঞ্জন যেন মৃত হয়ে গেছিল তার কাছে।সে নিজেকে অপরাধী ভাবছিল।
লোকটি বিনম্র ভাবে এগিয়ে এসে বলল আজ রাত্তিরে আপনারা আমার অতিথি।আমার নাম রাজা সেন।
রঞ্জন বলল আমি রঞ্জন সরকার।আমার স্ত্রী ভাস্বতী গাঙ্গুলি সরকার।
তিনজনেই হাতজোড় করে নমস্কার বিনিময় করলো।তারপরে আর একবার পেছন ফিরে তারা তাকালো নদীটির দিকে।নদীর চরিত্র বড় দুর্বোধ্য।
ওরা এগিয়ে গেল পাহাড়ের সরু পথ বেয়ে।বড় পাথরটার আড়ালে লোকটার ঘর।
ফেরা পথটুকু দীর্ঘক্ষণ মনে হয়।রঞ্জন লোকটির সাথে কথা বলছে ভাস্বতী একা একা হাঁটছে আগে আগে।বৃষ্টি থেমে গেলেও এদিক ওদিক জল ঝরার শব্দ।পাহাড়ে নিস্তব্ধ আঁধারে কয়েকটা শালিখ পাখি কিচিরমিচির করে ফিরে যাচ্ছে।
এ পাহাড়ে বিশেষ কোনো ফুলের সমারোহ নেই।তবে একধরনের সাদা পাহাড়ী ফুলের পরগাছা মাঝে মাঝে ঝিলিক দিয়ে ওঠে।রাত্রে যখন এখানে থাকতেই হবে—এ সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে যাওয়ায় ভাস্বতীর মনে কোন জড়তা নেই।
—আপনি এখানে কতদিন আছেন?
—অনেক সময়।এই ধরুন দশ বছর।
—-দশ বছর! কি করেন আপনি?
—-আমি সাপ ধরার ব্যবসা করি।
পাহাড়ে এমনভাবে বাড়ী বানিয়ে থাকা অসম্ভব কিছু নয়।বিদেশের ছেলেমেয়েরা অনেকেই থাকে–রঞ্জন দেখেছে।হয়তো এদেশেও অনেকে রয়েছে,সে খবর রাখেনি।কিন্তু সম্পূর্ণ একা একা?
—আপনি কি কলকাতার?
লোকটি কি একটা যেন ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল।বলল উঁহু ত্রিপুরা।
বাড়ীটা তাঁবু ও কুঁড়েঘরের মাঝামাঝি।কাঠের ফ্রেমে তিনপাশে ত্রিপল লাগানো।শক্তপোক্ত কিছু গাছের কাঠ দিয়ে ঘেরা।পাহাড়ই একদিকের দেওয়াল।ওপরে টিন।ভাস্বতী এরকমই এক কুঁড়ে ঘরে হয়তো থেকে যাওয়ার বাসনা করেছিল।
ভিতরে দুটি কামরা।একটিতে দুটি ক্যাম্প খাট পাতা,টুকিটাকি জিনিসপত্র,একটি রাইফেল।পাশের ঘরে শুধু অনেকগুলি খাঁচা।
ঘরে ঢুকে লোকটি রেইনকোটটা খুলে ফেলার পর দেখা গেল,তার লম্বা দীর্ঘ চেহারা।তবে তা মেদহীন পেটানো ধাতুর মত শক্ত।মুখের মধ্যে সুশ্রী একটা ভাব হয়তো অনেক আগে ছিল।পাহাড়ে থাকতে থাকতে তা যেন রুক্ষ হয়ে গেছে।রেনকোটের তলায় সে শুধু পরেছিল ফুলপ্যান্ট আর স্যান্ডো গেঞ্জি।জামা-টামার বালাই নেই।হাতের বাইসেপ্স গুলো স্পষ্টতই দৃঢ় লোহার মত।
—-আপনাদের জামা কাপড়তো সব ভিজে গেছে।সঙ্গে আর কিছু আছে?
—-রাত কাটাবার প্ল্যান ছিল না।তাই সঙ্গে কিছু আনা হয়নি।
—-ভিজে পোশাক পরে তো থাকতে পারবেন না।আর আমার কাছে তো ধুতি-টুতিও কিছু নেই।কয়েকটা পাজামা আছে অবশ্য-তার দুটো পরে নিয়ে জামাকাপড়গুলো মেলে দিন, শুকিয়ে যাবে।
—-থাক না,তার আর দরকার নেই।
লোকটি বিছানার তলা থেকে দুটো পাজামা আর গেঞ্জি বার করে রঞ্জনের হাতে দিল।
বলল ইস্ত্রি না করা থাকলেও কাচা আছে ব্যাবহার করার কোনো অসুবিধে নেই।
—-আপনাকে খুবই অসুবিধেয় ফেললাম।
লোকটি পর্যায়ক্রমে দুজনের দিকে তাকিয়ে হাসলো।তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
লোকটি ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার পর ওরা দুজনে চুপচাপ হয়ে রইলো।ভিজে শরীরে কাঁপুনি দিচ্ছিল।দুজনে পরস্পরের অতি চেনা মানুষ,দু-এক মুহূর্ত যেন কথা খুঁজে পায় না।চোখ সরিয়ে নেয়।
ভাস্বতী বা রঞ্জন দুজনের কেউই অন্যের পোষাক পরা পছন্দ করে না।অথচ উপায় তো নেই।
ভাস্বতী একটু হালকা হেসে বলল আমি কি সারারাত এই পাজামা পরে থাকবো।
—-ভিজে শাড়ি পরে সারারাত থাকতে পারবে না।ঘন্টাখানেকের জন্য একটু মেলে দাও।যদি অল্প শুকিয়ে যায় পরে নিও।
ঘরের একটা দরজা আছে দরজাটা আলগা।পাশে রাখা আছে।রঞ্জন ওটা সরিয়ে এনে লাগিয়ে দিল।প্যান্ট,শার্ট,জাঙ্গিয়া,গেঞ্জি খুলে সেই পাজামা আর গেঞ্জি পরলো বিনা বাক্যব্যয়ে।চুপচাপ দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য দেখার পর ভাস্বতী শাড়িটা ছেড়ে ফেলল।সিল্কের শাড়ি জলে ভিজে বেজায় ভারী।মেলে দিলে শুকোতে বেশিক্ষন সময় লাগবে না।ব্লাউজটা খুলে ফেলার পর কালো সায়া আর কালো ব্রাতে ফর্সা শরীরটা মোহময় হয়ে উঠলো।যেন সে প্রাচীন মিশরের দেবদাসী।
ঘরের ভেতরটা আবছা অন্ধকার।ভাস্বতী রঞ্জনের কাছে এসে তার কাঁধের উপর দুই হাত রেখে বলল, তুমি রাগ করেছ?
-উই বিহেভড এজ ফুলস।কিছু না জেনেশুনে আমাদের এরকম আসা ঠিক হয়নি।
ভাস্বতী রঞ্জনের থুতনিটায় চুমু দিয়ে বলল এখন আর চিন্তা করে কি হবে।একটা তো থাকার জায়গা পাওয়া গেছে।
—-অচেনা লোকের কাছে থাকতে আমার ভালো লাগে না।
—-কত অচেনা জায়গায় তো আমরা থাকি।
—-সেখানে আমরা টাকা দিয়ে থাকি,হুকুম করি।সে জায়গা আর এ জায়গা কি এক?
ভাস্বতী ম্লান গলায় বলল এখন থেকে তুমি কি আমার ওপর সবসময় রাগ করে থাকবে?
—-তোমার ওপর রাগ করবো কেন?
—-হ্যাঁ করেছ তো।
রঞ্জন ভাস্বতীকে আলিঙ্গন করে বলল তুমি একদম কথা শুনলে না।আসবার জন্য যেভাবে জেদ ধরলে।
—-আমর কিন্তু বেশ ভালো লাগছে।
রঞ্জন ভাস্বতীর ঠোঁটে ঠোঁট জেঁকে দিল।ভাস্বতীর শরীরটা উষ্ণ।একটু-আধটু বিপদের গন্ধ পেলেই তার শরীরী চাঞ্চল্য বাড়ে।সে নিজের ঠোঁট রঞ্জনের ঠোঁটে পিষে দিতে লাগলো।
ব্রা পরিহিত কোমল রূপসী স্ত্রীকে আলিঙ্গন করে চুম্বন খেলা দীর্ঘক্ষণ করবার ইচ্ছে হলেও রঞ্জন করলো না।নিজের উষ্ণ স্ত্রীর কাছে একটু বিরতি পেয়ে বলল তাড়াতাড়ি করে নাও।ভদ্রলোক বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন।
ভাস্বতী তার অন্তর্বাসের বাঁধন খুলতেই আবছা আলোতে নগ্ন বক্ষদেশ দেখা গেল।সে সম্পুর্ন রকমের সুবিধাভোগীনি কারণ সে একটা নিখুঁত রকমের শরীর পেয়েছে।ভাস্বতীর উজ্জ্বল নগ্ন স্তনের আভায় উদ্বেলিত হচ্ছিল তার শরীর।সুন্দরী, বুদ্ধিমতী, দুঃসাহসী নারীর উদ্ধত বক্ষ হলে তা সম্পুর্ন নিখুঁতই বলা যায়।ভাস্বতী তেমনই উন্নত কোমল স্তনের অধিকারিণী।গোপন ব্লাউজের অন্তরালে তার হৃদয়স্পন্দন স্তনদ্বয়ের সাথে একাত্ম হয়ে থাকে।
সম্পুর্ন শরীরটা এগিয়ে গেল খাটের দিকে।এক এক করে পাজামা গেঞ্জি তুলে নিল,পরলো।
রঞ্জন চামড়ার ব্যাগ থেকে টর্চটা বেরকরে ভাস্বতীর গায়ে ফেলে বলল তোমাকে মজার দেখাচ্ছে।
টর্চের আলোর আভা পেয়ে লোকটি বাইর থেকে বলল ভেতরে একটা হ্যাজাক আছে জ্বেলে নিতে পারেন।
ভাস্বতী বলল আমি এইরকম ভাবে বেরুবো?
রঞ্জন বলল কি আর করা যাবে?গেঞ্জিটাও ফুটোফুটো।
ভাস্বতী ওদের বড় তোয়ালেটা গায়ে জড়িয়ে নিল।তার মুখে লজ্জার চিহ্ন নেই,রয়েছে কৌতুক।নিজের শরীরটা নিয়ে সে বিব্রত বোধ করে না কখনো।কিন্তু তার একটু ঠান্ডা লেগে গেছে এর মধ্যে—নাক সুলসুল করছে।
রঞ্জন দরজাটা খুলতে গিয়েও থেমে গেল–কি ভেবে রিভলবার সমেত কোমরে বেল্টটা জড়িয়ে নিল।তারপর দরজা খুলে বাইরে এলো।
লোকটা বাইরে বসে একটা স্টোভ জ্বালানোর চেষ্টা করছে।ভাস্বতী তাকে জিজ্ঞেস করলো আপনার কাছে অ্যাসপিরিন জাতীয় কিছু আছে?
মুখ না ফিরিয়ে সে বলল না।
তারপর ওদের পোশাক দেখে বলল কি আর হবে একটা রাত কষ্ট করে কাটিয়ে দেন।
—-কাল নদীর জল কমবে?
—-যদি বৃষ্টি না হয়।
—-আপনি এখানে একা থাকেন?
—-এখনো দ্বিতীয়জনকে কি দেখতে পেয়েছেন এই জঙ্গলে?আমার সাথে তবে থাকবেই বা কে?
ভাস্বতী জিজ্ঞেস করলো আপনার একা একা থাকতে খারাপ লাগে না?
লোকটা স্টোভটা জ্বেলে সেটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো।ভাস্বতীর মুখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে বলল আমাকে টারজান ভাববেন না।এ জঙ্গলের ছ মাইল দূরে আদিবাসী গ্রাম আছে ওরা আমায় চেনে।একশো তিরিশ কিমি দূরে ফরেস্টের অফিস।ওরা আমায় চেনে,জানে।আমার সাপ ধরার লাইসেন্স আছে।তাহলে আর একা কোথায়?
স্টোভটা নিয়ে ও দ্বিতীয় ঘরটাতে ঢুকে গেল।পেছন পেছন ওরাও এলো।একপাশে কতগুলো খাঁচা আর একটু রান্নার ব্যবস্থা।
—-ভাত চাপিয়ে দিচ্ছি।বিশেষ কিছু আতিথ্য করতে পারবো না,এজন্য দুঃখিত।
রঞ্জন বলল আমাদের কাছে পাউরুটি আর জেলি আছে।ভুলেই গেছিলাম।
ওগুলো এখন খেয়ে নিতে পারেন।রাতে ভাত, আলুসেদ্ধ আর পেয়াজ।ঘি আছে টাটকা।ডিম ছিল–ফুরিয়ে গেছে।
ভাস্বতী বলল ঘি আর গরম ভাত তো চমৎকার।
—-প্রত্যেকদিন খাবারের পক্ষে একঘেয়ে।তাছাড়া আর যখন কিছু নেই,তখন ভালো লাগুক আর খারাপ লাগুক—
—-আমাদের ভালো লাগবে।আমি কি আপনাকে রান্নায় সাহায্য করতে পারি?
—-সাহায্য করার কিছু নেই।আমি একসঙ্গেই ভাত আর আলু সেদ্ধ চাপিয়ে দেব–
হিসহিস শব্দ শুনে রঞ্জন চমকে গিয়ে বলল খাঁচা গুলোর মধ্যে কি সাপ আছে নাকি?
—-গোটা তিনেক আছে।ভয়ের কিছু নেই।খাঁচা ভালো করে বন্ধ আছে।দেখবেন?
টর্চের আলোয় দেখা গেল।দুটি সাপ নির্জীব হয়ে পড়ে থাকলেও একটি ফণা তুলে দাপাদাপি করছে।সেটা অন্তত হাত চারেক লম্বা,মাথার ওপর প্রবাদ মতন পায়ের ছাপ আঁকা।
—-এগুলো আপনি ধরেছেন?
—-হ্যাঁ
—-ভাস্বতী বকুনির স্বরে বলে উঠলো, এগুলো নিজে ধরেন কেন?সাপুড়ে কিংবা বেদেদের দিয়ে ধরতে পারেন না?
লোকটি বলল সাপুড়েরাই কেবল সাপ ধরতে পারে এটা পুরোনো ধারণা।কতগুলো টেকনিক আছে শিখে নিলেই হল।ধরবেন নাকি সাপ?
লোকটির শেষের কথাটির মধ্যে যেন একটা স্পর্ধার আদি রসিকতা আছে।ভাস্বতীর তবু খারাপ লাগলো না।মাঝপথে রঞ্জন বলে উঠলো কারা কেনে সাপ?
—-বোম্বের হপকিনস ইনস্টিটিউট।তাছাড়া দেশে বিদেশে নানা গবেষণাকেন্দ্র,চিড়িয়াখানা কেনে।
—-আপনি কি নিজেই যান ওদের কাছে।
—-না সরাসরি আমি বিক্রেতা নই।আসলে আমি সে অর্থে ব্যাবসায়ী নই।ভাস্বতীর দিকে তাকিয়ে বলল আমি একজন সাপুড়ে সে অর্থে বেদে।আমার কাজই সাপ ধরা।আমি চালান করি ভুবনেশ্বরে।সেখানকার কেন্দ্রের মাধম্যে বিক্রি হয়।
সামনে একটা নদী।এই নদী পার হতে হবে।পুরুষটির নাম রঞ্জন।তার বয়স ৩৫।স্বাস্থ্য সুঠাম।সে হালকা চকোলেট রঙের প্যান্ট আর সাদা শার্ট পরে আছে।সাদা শার্ট তার প্রিয়।কাঁধে ঝুলছে ক্যামেরা।
মেয়েটির নাম ভাস্বতী, বয়স ৩২,সে পরে আছে গাঢ় নীল রঙের শাড়ি ও ব্লাউজ–ব্লাউজের তলায় ব্রা’য়ের আউটলাইন চোখে পড়ে।তার ব্রা–র রং কালো,সায়ার রং কালো,পরে দেখা যাবে।তার ডাক নাম সতী।সবাই এই নামেই ডাকে।তার নাম ঝর্ণা হলেও বেশ মানাতো।সে খুব সুন্দরী,অল্পবয়সী বালকের মতন দুরন্ত।রূপহীনা মেয়েদের গল্প আলাদা,রূপসী মেয়েদের গল্প আলাদা।এটা রূপের গল্প।এরা দুজনে স্বামী-স্ত্রী।এদের দুজনের অনেক আলাদা গল্প আছে।যেমন অনেকেরই থাকে।
এক একদিন হয় না দুপুর বেলাতেই আকাশটা সন্ধ্যের মত আঁধার হয়ে আসে।এই দিনটাও সেই রকম।নৈঋত কোন থেকে আস্তে আস্তে সারা আকাশ ছেয়ে আছে মেঘে।তবে সেই মেঘ যেন পাথরের মতন শক্ত,বর্ষণের কোন চিহ্ন নেই।এই মেঘের পটভূমিকায় পাহাড়টাকে গম্ভীর মনে হয়।এইসব দিনে কেউ নদী পেরিয়ে পাহাড়ে ওঠার স্বাদ করে না,কিন্তু ভাস্বতী খুব জেদি।
পৌঁছতে খুব দেরি হয়ে গেল।সকাল থেকেই গাড়ী খারাপ।রঞ্জন বলেছিল আজ আর বেরুবো না।
ভাস্বতী বলেছিল সারাদিন ডাকবাংলোয় বসে থাকবো না।
রঞ্জন বলেছিল কিন্তু গাড়ী যে খারাপ।
ভাস্বতী বলেছিল মাত্র দুবছর আগেও আমাদের গাড়ি ছিল না।তখনও আমরা বেড়াতে বেরুতাম।সুতরাং রঞ্জন গিয়েছিল দেড় মাইল দূর থেকে গাড়ীর মিস্ত্রী ডেকে আনতে।মিস্ত্রী এসে ঠুকঠাক করে জানালো গাড়ী গ্যারেজে নিয়ে যেতে হবে।নিয়ে যাওয়া হল ঠেলতে ঠেলতে।রঞ্জন চেয়েছিল অনেকক্ষণ সময় লাগুক।মিস্ত্রী সম্প্রদায় জানালো গাড়ীর অনেক অসুখ,দুদিনের আগে সারবে না।
নিশ্চিতভাবে রঞ্জন ফিরে এসে বলল দুদিনের আগে কোথাও যাওয়া যাবে না।গাড়ী পাওয়া যাবে না।
ভাস্বতী বলল বাস রয়েছে।মানুষ বাসেও বেড়াতে যায়।নইলে বাসগুলো চলে কেন?
রঞ্জন বলল ভুল,বাসে লোকে কাজকর্মে যায়।বেড়াতে যায় না।তাছাড়া বাস নদীর ধার পর্যন্ত যায়।নদী থেকে তিন-চার মাইল দূর দিয়ে বাস যায়।এমন পাহাড়ী বুনো নদী অবধি কে’বা যাবে।
—হাঁটতে হবে বলে তুমি ভয় পাচ্ছো!
রঞ্জন ভীতু নয়।তার শরীরে শক্তি আছে।বুকে সাহস আছে।সে পৃথিবীর হেরে যাওয়া মানুষের দলে নয়।বরং সে অতিরিক্ত পেয়ে থাকে।সে সাঁতারে মেডেল পেয়েছে,কলেজে ক্রিকেট খেলেছে,ভূতে বিশ্বাস করে না।শহরের রাস্তায় হঠাৎ হৈচৈ শুরু হলে সে দৌড়তে শুরু করে না।দাঁড়িয়ে দু-এক দন্ড দ্যাখে।কিন্তু সে পাহাড়ে উঠতে ভালোবাসে না।ভালোবাসে না-ভালোবাসে না,এর কোনো যুক্তি নেই।মোটরগাড়ী শুদ্ধ তাকে পাহাড়ে তুলে দাও-সে বিখ্যাত সৌন্দর্য্যগুলি উপভোগ করবে।কিন্তু ওইসব সৌন্দর্য্যের লোভে সে হেঁটে পাহাড়চূড়ায় উঠবেনা।তবে সে পরিশ্রম বিমুখ নয়।সমুদ্রে সাঁতার কাটতে বলুক না কেউ রঞ্জন এককথায় রাজি।অনেক মানুষেরই এরকম অদ্ভুত একটি দুর্বলতা থাকে।
—-বিশেষত নদী পেরিয়ে পাহাড়টি দেখতে যাওয়া সম্পর্কে তার মনে অন্য একটি আপত্তি ছিল।পাহাড়টি সম্পর্কে একটি কুসংস্কার জড়িত।সে কুসংস্কারের প্রশ্রয় দিতে চায় না।ভাস্বতী যাবেই যাবে।এই ধরনের গল্প শুনলেই ভাস্বতী পরীক্ষা করে দেখতে চায়।হাতের কাছেই যখন রয়েছে।রঞ্জনের অভিমত হচ্ছে এইসব কুসংস্কার পরীক্ষার আগ্রহও একধরনের স্বীকার করে নেওয়া।
—-তুমি কুঁড়েমি করে যেতে চাইছোনা,তাই বলো!অত সব যুক্তি দেখাচ্ছো কেন?
রঞ্জন ট্রাউজার ও গেঞ্জি পরে বসেছিল ডাকবাংলোর বারান্দায়।তার চওড়া কব্জিতে বাঁধা ঘড়ির কাঁচে রোদ পড়ে ঝলসে উঠছে।তার সুঠাম স্বাস্থ্য,এই মানুষকে দেখে কেউ অলস বলবে না।
তবু রঞ্জন হেঁসে বলেছিল এক একদিন কুঁড়েমি করতেও মন্দ লাগেনা। এসো না আজ সারাদিন শুয়ে থাকি।
ভাস্বতী তার হাত টেনে ধরে বলেছিল না,ওঠো।
অতএব বেরিয়ে পড়তেই হয়।স্থানীয় লোকজন কেউ কেউ বলেছিল পাহাড়টাতে উঠতে তিনঘন্টা,নামতে তিনঘন্টা লাগে।আবার কেউ কেউ বলেছিল ও পাহাড়ে ওঠাই যায় না।দেখতে ছোট হলে কি হবে।আবার কেউ বলেছিল সুন্দর রাস্তা বানানো আছে,কোন অসুবিধে নেই।বনাঞ্চলের এই এক অসুবিধে শ’য়ে শ’য়ে পাহাড় অজানাই থেকে গেল।নির্জনতার দম্ভ নিয়ে তারা মাথা উঁচিয়ে থাকে।পাহাড় এবং জঙ্গলের পথ সম্পর্কে মানুষের নানারকম মত থাকে।যারা রাস্তা মাপে তারা ছাড়া কেউ সঠিক দূরত্ব আন্দাজ করতে পারে না।পাহাড় কারুর কাছে সবসময়েই দূরে,কেউ ভাবে যতই দূরে হোক যাওয়া যায়।তবে এই পাহাড়টির কথা একটু আলাদা।এরা পাহাড়টিকে ভক্তিও করে আবার ভয়ও করে।
রঞ্জন বিরক্ত হয়ে মন্তব্য করেছিল এদের কারোর কথা বিশ্বাস করা যায় না।কারোর সাথে কারোর মেলে না।
ভাস্বতী বলেছিল গিয়েই দেখলে বোঝা যাবে কোনটা সত্যি।
রঞ্জন সাহসী,ভাস্বতী দুঃসাহসীকা।অথবা,গোঁয়ার শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ।ঝরঝরে বাস,কিন্তু তার ফার্স্টক্লাস,সেকেন্ড ক্লাস,থার্ড ক্লাস আছে।
ভাস্বতীর ইচ্ছে থার্ড ক্লাসে আর সব নারী,পুরুষের সঙ্গে মিলে মিশে যায়।রঞ্জন তাতে সম্মতি জানায়,আপত্তি জানানো অর্থহীন বলে।বাসে উঠে এই ভিড়ভাটটায় রঞ্জনের ভালোলাগেনা।যাদের দেখলে বোঝা যায় পকেটে পয়সা আছে,শহুরে শিক্ষিত,সঙ্গে ফর্সা চেহারার রমণী থাকলে গেঁয়ো জঙ্গলাকীর্ণ লোকেরা একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে দ্যাখে।তবু ভালো রঞ্জন আর ভাস্বতীর ভাষা এখানে কেউ বোঝে না।ওড়িয়া কিংবা আদিবাসীদের এক ওড়িয়া মিশ্রিত নিজস্ব ভাষা চলে।সে ভাষা বোঝা দুস্কর।ওড়িশা।
দেড় ঘন্টার পথ তবু প্রায় তিনঘন্টা লেগেছিল।তবু ভাস্বতী বিরক্ত হয়নি সে উচ্ছলতায় রঞ্জনকে মাতিয়ে রেখেছিল।বেড়াতে এলে ভাস্বতী একটু বেশি উচ্ছল হয়ে ওঠে।মানুষ মুক্তিকামী। যতই তার জীবন আধুনিকতা, স্বাধীনতা থাক না কেন।তবু সে মুক্তি খোঁজে।ভাস্বতী ব্যতিক্রম নয়।কয়েকটা জনপদ পেরিয়ে গাড়িটা এগিয়ে ওদের যেখানে নামতে হয় সেখানে কয়েকটা খাবারের দোকান।খাঁটি অতন্ত্য বেশি গন্ধময় দুধে ভেজানো চা।কলকাতার চা’য়ের কোনো স্বাদ নেই তাতে।ওরা দু গেলাস চা নেয়।পরে আরো এক গেলাস।
এরপর মাইলের পর মাইল,প্রায় তিন মাইল হাঁটা পথ।ইতিমধ্যে মেঘ ঘনিয়ে আসে।দ্বিপ্রহরকে মনে হয় সায়াহ্ন।ঝলমলে বহিঃদৃশ্যকে অপ্রসন্ন মনে হয়।কোথাও পাখি নেই।ইতিউতি ফড়িং ওড়াউড়ি করছে।এরই মধ্যে মেঘ চিরে একটা বিমান উড়ে যায়।খুবই অবাস্তব মনে হয়।এমন ঘন অরণ্যে এই শব্দ বেমানান লাগে।পায়ের তলায় শাল পাতার খসখস নীরব শব্দ।লম্বা লম্বা মোটা গাছ এলোমেলো পাহাড়ে উঁচিয়ে আছে।
রঞ্জন বলল আজ আর যাওয়া উচিত নয়।আকশের অবস্থা একদম ভালো নয়।
ভাস্বতী বলল আমার একদম ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে না।
—-যদি অনেক রাত্তির হয়?
—-যেখানেই থাকি রাত্তিরতো হবেই।
ভাস্বতীর এই কথাটিকে কোনো যুক্তি বলা যায় না।কিন্তু মেয়েরা এমন অযৌক্তিক কথা বলে বলেই তো মোহময়ী।কেউ কেউ বলে রহস্যময়ী।রঞ্জনের মত যুক্তিবাদী মানুষও ভাস্বতীর এই কথা শুনে হাসলো।
নদীটি ছোট।হেঁটে পার হওয়া যায়।প্রতক্ষ্য প্রমান হিসেবে একটা গরুর গাড়ী পার হয়ে আসতে দেখা গেল।গরুর গাড়িটি পাহাড় থেকে আসেনি।নিশ্চিত ওপাশে কোনো লোকালয়ের রাস্তা আছে।
ভাস্বতীর কাঁধে ঝোলানো একটি চামড়ার ব্যাগ।তাতে টুকিটাকি ব্যবহার্য্য জিনিসপত্র।বেশি ভারী।রঞ্জনের কাঁধে শুধু ক্যামেরা।এতে যেন কেউ মনে না করে রঞ্জন তার স্ত্রীকে দিয়ে ভারী ব্যাগ বইয়ে নিচ্ছে।ভাস্বতী সুন্দরী ও আধুনিকা–সে সাধ্য কি রঞ্জনের?আসলে ব্যাগটা ওরা ভাগাভাগি করে নেবে বলেছিল।কিছুক্ষন আগে ভাস্বতীর অনুরোধে সেটা ভাস্বতী নিয়ে নিয়েছে।রঞ্জন ভাস্বতীর হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে নেয়।নদী পার হবার জন্য শাড়ি উচু করলো ভাস্বতী।রঞ্জনও গুটিয়ে নেয় ট্রাউজার্স।
নদীর জলে পা দিয়েই বোঝা গেল জল যেমন ঠান্ডা,তেমনই তীব্র স্রোত।পাহাড়ী ছোট নদীগুলো খুব তেজি হয়।এটা তেমনই একটা নদী।তার বুকের উপর দিয়ে হেঁটে যেতে পারো,কিন্তু তাকে সমীহ করতে হবে।
তবে এ নদী সাঁতার কাটার মত নয়।তবু জলে পা দিয়ে রঞ্জনের মেজাজ ভালো হয়ে যায়।
—-সতী আমার হাত ধরো।
ভাস্বতী বনভূমিতে বেড়াতে এলে সবকিছুতেই আনন্দ পায়।এই স্রোতের জল,স্রোত তার স্পৃহাকে আনন্দিত করে তোলে।একহাতে চটি,অন্য হাত রঞ্জনের বাহুতে।বড় বড় পাথরের টুকরো তার পায়ে খোঁচা দেয়।তবু সে হাসছে।হাসতে হাসতে বলে যদি কোন জায়গায় জল বেশি থাকে?
ভাস্বতী সাঁতার জানে না।তবে জল বেশি থাক বা না থাক ভাস্বতীর প্রশ্নে ভয়ের চিহ্ন নেই।এ সবই–কৌতুক।রঞ্জনের মুখ থেকে সে আশ্বাসবাণী শুনতে চায়।যা শুনিয়ে রঞ্জন পরিতৃপ্ত হবে।নির্ভরযোগ্যতাই প্রধান যোগ্যতা।রঞ্জন নির্ভরযোগ্য তার স্ত্রীর কাছে।সে পাহাড়ে হোক বা জলে।
ভাস্বতীর শাড়ি উঠেছে হাঁটু পর্যন্ত।ফর্সা পা দুটোকে ধুইয়ে জলের স্রোত বয়ে চলেছে।ক্রমশ জল বেড়ে চলেছে।এমন নির্জনতাই নারী পুরুষকে আনন্দ দেয়।স্বামী-স্ত্রীকেও।শয়নকক্ষে কেউ থাকে না—তবু এই আকাশের নীচে পাহাড় আর নদীর পটভূমিকায় দুজনে নিরালা হবার স্বাদ আলাদা।ভাস্বতী নিচু হয়ে এক আঁচলা জল ছিটিয়ে দেয় রঞ্জনের গায়ে।
রঞ্জন বিরক্ত হল না।স্রোতস্বিনী নদীতেও সে ঘুরে দাঁড়ালো ভাস্বতীর দিকে।ভাস্বতীর কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে হাসতে হাসতে বলল, ফেলে দিই ফেলে দিই?
কেউতো এখানে দেখার নেই।কেউ তো জানে না যে সে কলকাতার একটি বড় সংস্থার দায়িত্বপূর্ণ অফিসার! এখানে একটু ছেলেমানুষী করতে দোষ কি?
কেউ না দেখলেও কিছু কিছু ব্যাপার আসে যায়।ভাস্বতী তার শাড়ি উরুর অনেকখানি তুলে ফেলেছে।রঞ্জনের চোখ গেল সে দিকে।এবার তার দৃষ্টিতে অন্যধরনের হাসি।ভাস্বতীর ফর্সা উরু,নীল শাড়ি যেন যবনিকা।যে পুরুষ তার স্ত্রীকে শয়নকক্ষে নিরাবরণ দেখেছে।ঘুমের মধ্যে ওই উরুরু উপর হাত রেখেছে–অনুভূতিহীন হাত–বহু দিনের বেলা তার স্ত্রী যখন শাড়ি পাল্টেছে তার কাছাকাছি,হয়তো বা সে পড়েছে সেসময় কোনো অকিঞ্চিতকর বই—আজ সে সেই শরীরের আভাস পেয়ে রোমাঞ্চিত।এরকমও হয়।
জল আর একটু বাড়লো।ভাস্বতী আর শাড়ি তুলল না।সবটাই ফেলে দিল।ভিজে একাকার।এ অঞ্চলের আদিবাসী মেয়েরা শাড়ি নদীতে ভেজায় না।অনেক লোক থাকলেও তারা শাড়ি তুলে নেয়।কারন তাদের আর হয়তো শাড়ি নেই।এই মুহূর্তে ভাস্বতীর কাছেও কোন দ্বিতীয় শাড়ি নেই।তবুও সে ভেজালো।খানিকটা নিজের স্বামীর কাছেই লজ্জা পেয়ে।
ভাস্বতী সাধারণ সুন্দরী নন।প্রত্যেক সুন্দরীরও নিজস্ব খুঁত থাকে।হয়ত ভাস্বতীরও আছে।কিন্তু ভাস্বতীর বুদ্ধিমত্তা,দুঃসাহস,আনন্দউচ্ছলতা,মুক্তিকামী হৃদয় তার রূপসী ফর্সা তনুকে অতিরিক্ত রূপসী করে তুলেছে।সে যেন এই স্রোতস্বিনী নদীরই প্রতিরূপ।
ভিজে শাড়ি ঠেলে ঠেলে এগিয়ে যেতে সময় লাগে।ভাস্বতী এগিয়ে চলে।রঞ্জন জলের তল মেপে ধীরে ধীরে পিছনে এগোয়।
—-দ্যাখো,কি সুন্দর ছোট মাছ!
—-তাড়াতাড়ি এসো সতী!
—-তুমি মাছগুলো দেখছো না কেন?
—-তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে না?
—-এখনই পৌঁছলাম।এরই মধ্যে ফেরার কথা!
—-সাড়ে সাতটার পরে আর বাস নেই।এখানেই রাত কাটাতে হবে তাহলে।
—-দারুন হবে তাহলে।বেশ বনের মধ্যে—
সরু সরু ছাইরঙা মাছ জলের মধ্যে সুরুৎ সুরুৎ করে ঘুরছে।এই জলে কোথাও শ্যাওলা পাওয়া মুস্কিল।স্বচ্ছ জলের তলদেশে পাথর দেখা যায়।মাথার ওপর কয়েকটা ফড়িং ঘুরতে থাকে।
মাছ দেখার অতি উৎসাহ নিয়ে নিচু হতেই ভাস্বতী আর ভারসাম্য ঠিক রাখতে পারে না।জলের স্রোত তাকে টেনে নিয়ে যায় দূরে। ভয়মিশ্রিত হাসিতে চেঁচিয়ে ওঠে ভাস্বতী।
রঞ্জন দেখতে থাকে ভাস্বতীর জলে ভিজতে থাকার দৃশ্য।রঞ্জন চেয়েছিল জলে ঝাঁপ দিতে কিন্তু গলায় ক্যামেরা থাকায় অপেক্ষা করছিল।তাছাড়া স্রোত ক্রমাগত বাড়তে থাকলেও এখনো অগভীর।
ভাস্বতী ততক্ষনে উঠে দাঁড়িয়েছে।নীল শাড়িটা ভিজে লেপ্টে রয়েছে গায়ে।ভেজা শাড়িতে কোমল মসৃন পেট ও নাভি দৃশ্যত হেমেন মজুমদারের ছবি।কালো ব্লাউজে আবৃত নারীবক্ষ স্বচ্ছ হয়ে রয়েছে।
রঞ্জন ক্যামেরা নিয়ে দু-পা ছাড়িয়ে দাঁড়ায়।নিজের সুন্দরী স্ত্রীর এমন রূপমাধুরী দেখে লোভ সামলাতে পারে না কয়েকটা ছবি নেওয়ার।প্রথম ছবিতেই ভাস্বতী ভেঙচি কাটলো।দ্বিতীয় ছবিতে ভাস্বতী দু’হাত তার চুলে,মুখ ওপরের দিকে,মেঘের ছায়া পড়ে সেই মুখ পৌরানিক নারীর মতন।ভাস্বতীর শরীরে একটা শিহরণ বয়ে গেল।সেই মুহূর্তে,সেই বিশেষ মুহূর্তেই মনে হল তার: কি সুন্দর এই বেঁচে থাকা।
গহন অরণ্যে দশদিকব্যাপি নির্জনতার মধ্যে এক নদী,তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে সর্বাঙ্গ ভেজা নারী।এবং সেই দৃশ্যকে চিরস্থায়ী করে রাখছে রঞ্জন।
ওপাশে পৌঁছে রঞ্জন রুমাল খুলে ঘড়ি দেখলো।তিনটে দশ।গ্রীষ্মকালের দীর্ঘবেলা।রাত্রি নামার আগে অনেকটা সময় আছে।পাহাড়টি বিশেষ বড় নয়।অধিকাংশ ভারতীয় পাহাড়ের মত।এর চূড়ায়ও একটি মন্দির আছে।মন্দিরটি দূর থেকে দেখা যায়।অচেনা অজানা জনমানবশূন্য জায়গায় এরকম মন্দির দেখলে স্বস্তি লাগে।
চামড়ার ব্যাগে তোয়ালে ছিল।ভাস্বতী মাথা মুছলো,মুখ মুছলো।শাড়ি,ব্লাউজ সম্পুর্ন ভিজে গেছে।তার আর কিছু করার নেই।রঞ্জন চিন্তিত হলে ভাস্বতী বলে আমার কিছু হবে না।অত সহজে ঠান্ডা লাগবে না।
পাহাড়ী জঙ্গল যেমন হয়।ওড়িশার প্রত্যন্ত জঙ্গলে এরকম অজস্র পাহাড় থাকে।যা মানুষের চোখে অজানা।সরু একটা রাস্তা ঝোপের মধ্য দিয়ে উঠে গেছে বাঁ দিকে।সেটাই সম্ভবত ওঠার রাস্তা।একটা রাস্তা ডান দিকে ঝোপের মধ্যে মিলিয়ে গেছে।তার গতি ঢাল বেয়ে নিচু।ওটা হয়তো কোনো দিকে সমতলে গেছে।
ওঠার রাস্তাটি সরু হলেও দুর্গম নয়।বহু ব্যাবহারের চিহ্ন আছে।তবে বোঝা যায় অনেককাল কেউ ওঠে না।একটু খানি উঠেই ঢুকে গেছে বনের মধ্যে।
ঝোপ ঝাড় তবে খুব বেশি নয়।প্রত্যেকটা গাছকে একে ওপরের থেকে আলাদা চিহ্ণিত করা যায়।এসব বনে অনেক আগেই বন্যপ্রাণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।বাঘ এখানে কেবল উপকথার মত প্রাচীন বুড়োদের অভিজ্ঞতার গল্পে। ছোটখাটো কিছু প্রাণীর উপদ্রব থাকলেও ভয় নেই।রঞ্জন সশস্ত্র।তার লাইসেন্স পিস্তল আছে।
সিগারেট ধরিয়ে রঞ্জন বলল একটা গাইড-টাইড নিয়ে এলে হত।
ভাস্বতী মোহময়ী গলায় বলল এখন আর কেউ থাকলে আমার ভালো লাগতো না।
—-যদি রাস্তা হারিয়ে ফেলি?
—-একটাই তো রাস্তা দেখতে পাচ্ছি।
মন্থর পদযাত্রায় ওরা এগিয়ে যায়।এসেই যখন গেছে এখন দ্বিধা না রেখে উপভোগ করা শ্রেয়।
—-তুমি আসতে চাইছিলে না।জায়গাটা কি সুন্দর বলোতো।
—-হ্যাঁ,বেশ ভালোই জায়গাটা।
—-আমাদের এখানে যদি কেউ নির্বাসন দিত তো বেশ হত! আমরা সারাজীবন এখানেই থেকে যেতাম।
—-কতদিন?
—-আমি সারাজীবনই থাকতে পারি।
—-সত্যি পারবে?বাথরুম?
ভাস্বতী লজ্জা পেল।বিছানার বদলে মাটিতে শুতে দিক তার আপত্তি নেই।খাবার জুটুক না জুটুক তাতেও আপত্তি নেই।কিন্তু পরিচ্ছন্ন বাথরুম থাকা চাই।ঝকঝকে বাথরুম না পেলে তার মেজাজ খারাপ হয়ে যাবে।যতবার বেড়াতে গেছে,ভাস্বতী প্রথম ডাকবাংলোয় শোবার ঘরের বদলে বাথরুম পরীক্ষা করেছে।নোংরা ডাকবাংলোর জন্য নির্দিষ্ট ডাকবাংলো ছেড়ে এইবারে সাতাশ মাইল দূরের বাংলোতে আসতে হয়েছে রঞ্জনকে।
ভাস্বতী এখন তার চারিত্রিক দুর্বলতা গোপন করে বলল।তবু থাকতে পারবো।এখানে তো নোংরাই নেই।বেশ একটা কুঁড়েঘর বানিয়ে থাকতাম দু’জনে।
—-তারপর কুঁড়ে ঘরের সামনে একটা সোনার হরিণ আসতো।তুমি সেটা ধরে আনবার জন্য আবদার করতে আমার কাছে।
ভাস্বতী হেসে ওঠে।নিজের স্ত্রী’র কাছে এমন একটা চতুর শব্দ বলে রঞ্জন বেশ খুশি হয়।
রাস্তার পাশে পড়ে আছে একটা সিগারেটের প্যাকেট ও ইংরিজি খবরের কাগজ দোমড়ানো ভাবে।দুটোই খুব দূরের জিনিস বোঝা যায়।কৌতুহল বশতঃ রঞ্জন কাগজটির তারিখ লক্ষ্য করলো।দেড় মাসের পুরোনো।
একটা শাল গাছে ঠেস দিয়ে দাঁড়ালো রঞ্জন।সিগারেট ধরিয়ে বলল তুমি কি বিশ্রাম নেবে সতী?
—-আমি তো হাঁপিয়ে যাইনি।
—-পাহাড়ে উঠতে হয় খুব আস্তে আস্তে।প্রথমদিকে তাড়াহুড়ো করলে খুব কষ্ট হয়।
—-আমি পরেশনাথ পাহাড়ে উঠেছি।আমারতো কষ্ট হয়নি।তোমার কি হচ্ছে?
মিনিট চল্লিশেক বাদেই মনে হল তারা পাহাড়টার এক-তৃতীয়াংশ উঠে এসেছে।রঞ্জন তৃপ্ত হল।এই গতিতে গেলে তাড়াতাড়ি ফেরা যাবে।নামার সময় কমসময় লাগে।
এখান থেকে নদীটাকে অনেক নীচে মনে হয়।বনের আড়াল থেকে বোঝা যায় নদীর জলের তরঙ্গ।নদীর জলটা ভীষন কালো কুচকুচে মনে হয়।একটু আগেই তারা এ নদী পার করে এসেছে।ভীষণ নীল আর স্বাদু এ নদীর জল।
এমন বদলে গেল কি করে?
আসলে আকাশটা বদলে গেছে অনেকখানি।নীল আকাশ ঢেকে গেছে কালো মেঘে।নদীর রংও বদলে গেছে।রঞ্জন একটা পাথর তুলে নদীর জলে ছুঁড়ে ফেলবার চেষ্টা করলো।নদী অবধি পৌছালো না।
এই সময় ঝড় উঠলো।এবং সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টি।পাহাড়ী জঙ্গলের ঝড়বৃষ্টি খুব তীব্র হয়।বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা তীরের মতন বিঁধছে পাথরে।গাছগুলোর মাথা ঝটপট করছে বৃষ্টি আর মন্দ বাতাসে।
ওরা ছুটে গিয়ে একটা ঝাঁকড়া সেগুনগাছের তলায় দাঁড়ালো।প্রথম প্রথম জল লাগেনা।একটু পরে বৃষ্টির চেয়েও বড় বড় ফোঁটা ওদের ভিজিয়ে দেয়।রঞ্জন ক্যামেরাটা বাঁচাতে তড়িঘড়ি ব্যাগে ভরে নিল।আকাশ একেবারে ফেটে পড়েছে ভারী বৃষ্টিতে।পাহাড়ী রাস্তাটা এখন ঝর্নার মত।
ওদের ভ্রু কুঁচকে আসে।অল্প অল্প শীতের মতন হয়।এত অসম্ভব ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে বিপদের গন্ধ আসে।অচেনা নির্জন অরণ্যে এরকম ঝড়বৃষ্টি ভয়ের কারণ।
কিন্তু বিপদ আসেনি।ওরা দু’জন ভয়কে আচ্ছন্ন করার সুযোগ দেয় না।পরস্পরের দিকে হাসি বিনিময় করে।
রঞ্জন ভাস্বতীকে কাছে টেনে নেয়।ভাস্বতীকে বৃষ্টিতে সিক্ত অবস্থায় দেখে নিজের প্রণায়াবেগ চেপে রাখতে পারে না রঞ্জন।এমন বিপদের দিনে সুন্দরী স্ত্রীকে কাছে পেলে যেকোনো পুরুষই ঘনকামনায় বিভোর হবে।মিষ্টিমুখের মৃদু হাসিতে ভাস্বতীর ঠোঁটখানা কাঁপতে থাকে।ভাস্বতী রঞ্জনের পাঁচ বছরের পুরোনো স্ত্রী।এমন সুন্দরী,দুঃসাহসী,বুদ্ধিমতী স্ত্রী কি কখনো পুরোনো হয়? রঞ্জন ভাস্বতীর কোমল শরীরটাকে জড়িয়ে উষ্ণতা বিনিময়ের চেষ্টা করে।ঠোঁটের পাঁপড়ি দুটোকে নিজের ঠোঁটে চেপে ধরে।গাছের পাতা বেয়ে তখন প্রকৃতি যেন স্নানঘরের শাওয়ার।ঠোঁট দুটো মিশে ঘন চুম্বনে মেতে রয়েছে।স্বামী-স্ত্রীর একান্ত প্রেমময় স্থান নারী-পুরুষের ঠোঁট।চুম্বনের কয়েকটি মুহূর্ত দুজনের জীবন থেকে বিপদের অস্বস্তি মুছে যায়।রঞ্জন যেন গভীর চুম্বনে তার স্ত্রীকে আশ্বস্ত করছে।ভাস্বতী নিজের শরীরটাকে রঞ্জনের শরীরে আরো গভীর ভাবে মিশিয়ে দেয়।নরম বুকদুটো রঞ্জনের বুকে চেপে ধরে দীর্ঘস্থায়ী চুম্বন চলতে থাকে।
তারপর ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় দুজনের।পরস্পরের দিকে উজ্জ্বল দৃষ্টিতে তাকায় দুজনে।অঝোর বৃষ্টির ধারা ওদের দু’জনের মাথা গড়িয়ে পড়ছে।কড়কড় শব্দে হঠাৎ প্রচন্ড বজ্রপাত হয়।
রঞ্জন বলল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা বোধ হয় ঠিক নয়।দাম্পত্যের রোমান্সে এই বজ্রপাত যেন হিংস্রতার ছাপ রাখে–তৃতীয় অনাকাঙ্খিত ব্যক্তির মত।
রঞ্জন এদিক ওদিক তাকাতে থাকলো।গাছের তলা ছেড়ে বা কোথায়ই যাবে!
গাছগুলো থেকে ঝরে পড়ছিল প্রচুর শুকনো পাতা।কোথাও গাছের ডাল মড়মড় করে ভেঙে পড়ার শব্দ হচ্ছে।যে কোনো গাছ ভেঙে পড়বার সম্ভাবনা আছে কিংবা বজ্রপাত।
রঞ্জন ভাস্বতীর হাতটা ধরে বলল চলো,এখানে আর দাঁড়ানো যাবে না।
ছুটে গিয়ে দাঁড়ালো বড় একটা পাথরের কাছে।এখানে বেশি ভিজতে হবে কিন্তু গাছ ভেঙে পড়বার ভয় থাকবে না।
বৃষ্টি একটুও কমেনি।বরং বেড়েই চলেছে।
ভাস্বতী ক্ষুণ্ন গলায় বলল আমরা যাতে পাহাড়টায় না উঠতে পারি তার জন্য একটার পর একটা বাধা আসছে।লোকেরা এইজন্যই আমাদের এখানে আসতে বারণ করেছিল।
রঞ্জন ভাস্বতীর গালে টোকা মারলো।এসব কি বলছো কি?
—-যাইহোক না কেন আমরা ওই পাহাড়ে উঠবোই।
রঞ্জন বলল নিশ্চই উঠবো।তবে আজ বোধ হয় ফিরে যেতে হবে।সাড়ে চারটে বেজে গেল।আর বেশি দেরি করলে ফেরার উপায় থাকবে না।কাল আবার না হয় আসা যাবে।
ভাস্বতী তীক্ষ্ণ ভাবে জিজ্ঞেস করলো কাল ঠিক আসবে?
—-কেন আসবো না।এবার রেনকোট আনা হয়নি।এই যা মুশকিল।
একটা রোমান্টিক অভিলাষ ছিল।এই ঝড় বৃষ্টি কাদায় তা পুরোপুরি উবে গেছে।তবে কাল আবার ফিরে আসতে হবে।একবার যখন সে এই পাহাড়ের চূড়ায় উঠবে ঠিক করেছে,সে উঠবেই।দরকার হলে বারবার ফিরে আসবে।
বৃষ্টি থামবার কোনো লক্ষণ নেই।ব্যাঙের সম্মিলিত ডাক শুরু হয়েছে।
রঞ্জন তক্ষুনি ফেরার পথ ধরতে চায়।এই বৃষ্টিতে পাথরগুলো অত্যন্ত পিচ্ছিল।সেগুলিকে ভয়ঙ্কর বলা যেতে পারে।তবু সে ভাস্বতীর হাত ধরে বলল সাবধানে নামতে পারবে?
—-সে ম্লান গলায় বলল পারবো, ফিরে চলো।
কয়েক পা এগিয়েই রঞ্জন বুঝতে পারলো এটা হঠকারিতা।এরকম প্রকৃতির ভয়ঙ্কর রূপের সাথে প্রতিযোগীতা করার কোন মানে হয় না।
এত ঝড়বৃষ্টির মধ্যে পাহাড়ী ঢালু রাস্তায় কেউ পথ হাঁটে না।স্থানীয় আদিবাসীরা তো বৃষ্টিতে বনাঞ্চলে পা’ই বাড়ায় না।
হঠাৎই রঞ্জনের মনে হল পাশে একটা সরু জিনিস নড়াচড়া করছে।কেঁচো হতে পারে।কিংবা জোঁকও হতে পারে।রঞ্জন বুঝতে পারে বৃষ্টির সময় অরণ্যের এই সব প্রাণী দেখা মেলা নিশ্চিত।তারওপরে গোখরোর উপদ্রব পাহাড়ে বেশিই।
রঞ্জনের জুতোর মধ্যে ভিজে মোজা পরে হাঁটতে অস্বস্তি হচ্ছিল।জুতোখুলে মোজা খুলে নিল সে।ভাস্বতী নীচের দিকে শাড়ি,সায়া খানিকটা চিপড়ে নিল।ওরা এত ভিজেছে গা,মাথা মোছার কোনো মানে হয় না।
বৃষ্টিতে অরণ্য আরো বেশি নিঃঝুম হয়ে পড়েছে।ফেরার জন্য ওরা তৈরী হয়েছে এমন সময় সোনা গেল মনুষ্যকন্ঠ।একটা গানের মত আওয়াজ কথা শোনা যায় না,শুধু সুর—কণ্ঠস্বর খুব সুরেলা নয়—বেসুরোরা যেভাবে গান গায়,সেরকমই।
ওরা দু’জনে চোখ চাওয়াচাওয়ি করলো।কিন্তু কোনো কথা বলল না।
সুরটা শোনা যাচ্ছে।ক্রমশ পাহাড় থেকে এগিয়ে আসছে।জঙ্গল ভেদ করে।
একটু বাদেই পাথরের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো একটা মনুষ্য মুর্তি।
ক্রমাগত বৃষ্টির মধ্য দিয়ে এগিয়ে আসছে বিরাট লম্বা চওড়া লোকটা।
লোকটার পরনে হাঁটুর নীচ অবধি ধুসর কালচে রেইনকোট।মাথায় টুপি কপাল পর্যন্ত ঢাকা,পায়ে ভারী গামবুট।তার হাতে একটা লম্বা লোহার জিনিস,দেখলে মনে হয় একটা খুব বড় সাইজের চিমটে,সেটা দিয়ে সে ঝোপঝাড়ে আঘাত করতে করতে আসছে।আর আপনমনে গান গাইছে।কথা না বোঝা গেলেও গানের সুরটা চিনতে পারলো ভাস্বতী।এই পরিবেশে এরকম গান শোনা যায়!—‘যেদিন সুনীল জলধি হইতে উঠিল ভারতবর্ষ/সেদিন বিশ্বে সে কি কলরব,সেকি হর্ষ,সে কি মা ভক্তি…’
লোকটি প্রথমে দেখতে পায়নি ওদের।তারপর চোখ তুলে তাকালো।এগিয়ে আসলো ওদের দিকে।আপাদমস্তক ভালো করে দেখলো গম্ভীর ভাবে।ভাস্বতীর দিকেই তার বেশিক্ষণ দৃষ্টি,বলাই বাহুল্য।
লোকটির এমন ভাব,যেন সে অরণ্যের অধিপতি।যেন তার এলাকায় আগুন্তুক এসেছে।গম্ভীর ভাবে খুঁটিয়ে দেখছে সে।
গম্ভীর ভাবে বলল বাঙালি?
রঞ্জন বলল হ্যাঁ
—-বৃষ্টিতে আটকে পড়েছেন?
—-হ্যাঁ
—-ফিরে যাবেন?
—-তাই ভাবছি।
কথা বলার সময় লোকটি মাটিতে লোহার চিমটেটা ঠুকছিল।শব্দ হচ্ছিল কর্কশ ভাবে ঠন ঠন ঠন।
রঞ্জনের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল বছরের এই সময়টা খুবই খারাপ।
ভাস্বতীর দিকে তাকিয়ে বলল আপনি নিশ্চই উপরের মন্দিরটায় যেতে চাইছিলেন?
ভাস্বতীর বদলে রঞ্জনই উত্তর দিল সেরকমই ইচ্ছে ছিল।এখন আর হবে না।
লোকটি হাসলো যেন সে হঠাৎ কোনো পুরোনো ঘটনা মনে করে ফেলেছে।
বৃষ্টি থেমে গেলেও আকাশের রং ময়লা।অন্ধকার হয়ে রয়েছে চারপাশ।এইটুকু বোঝা যাচ্ছে যে আজ আর বিকেলের আলো ফুটবে না।
মাথার টুপিটা খুলতেই লোকটির মুখ এতক্ষনে দেখা গেল।বয়স অনুমান করা মুস্কিল চল্লিশের বেশি হলেও হতে পারে আবার পঞ্চাশও হতে পারে।একমাথা ঝাঁকড়া চুল,অবিন্যস্ত।খাড়া নাক,রোদে পোড়া তামাটে রঙ।তীক্ষ্ণ ঝাঁঝালো চোখ।কথা বলার ধরণও ভারিক্কি ধরণের।
—-আপনারা কোথা থেকে আসছেন?
—-কলকাতা থেকে।
লোকটি আবার হাসলো।যেন মনে হয় মুখে একরকম কথা বলে মনে অন্যকিছু ভাবে।
বলল কলকাতা অনেক দূর।এখন কোথা থেকে আসছেন?
রঞ্জন ডাকবাংলোটার নাম বলল।
লোকটাকে এবার চিন্তিত দেখালো।মাটিতে চিমটেটা গেঁথে দিয়ে টুপিটা পরিয়ে দিল।
ভাস্বতী এই প্রথম কথা বলল আপনি কোথায় থাকেন? কাছাকাছি?
লোকটি যেন চমকে উঠলো ভাস্বতীর গলার আওয়াজ শুনে।ভাস্বতীর মুখ ও ভিজে শরীরের দিকে তাকিয়ে থেকে আস্তে আস্তে বলল এই পাহাড়েই আমার ঘর।
রঞ্জন আর ভাস্বতী দু’জনেই অবাক হল।এই পাহাড়েই ঘর মানে!মন্দিরের পুরোহিত?না তো দেখে তো মনে হয় না।পরনের পোষাক ও রূপে এক বন্য আদিমতার ছাপ আছে।কিন্তু পাহাড়ে যারা থাকা তাদের পাহাড়ী বলে একে কি বলা যায়?
লোকটি পকেট থেকে সিগারেট বের করলো।কি মনে করে নিজে ধরানোর পর রঞ্জনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল চলবে?
রঞ্জনের সিগারেটের প্যাকেট বৃষ্টিতে ভিজে গেছে।সিগারেট পেয়ে সে কৃতজ্ঞতা বোধ করলো।বলল ধন্যবাদ।আমাদের সাড়ে সাতটার মধ্যে বাস ধরতে হবে।
—-তার আগে নদী পার হতে হবে।
—-হ্যাঁ আচ্ছা চলি।
—-কোথায় যাবেন?
—-নদীর দিকে।
রঞ্জন চামড়ার ব্যাগটা তুলে নিয়ে ভাস্বতীকে বলল চলো।
লোকটির সাথে তাদের পরিচয় হয়নি,নাম জানাজানি হয়নি।তাই আনুষ্ঠানিক বিদায় নেবার প্রশ্ন ওঠে না।অনেক দূরে বাঙালি দেখা হলে যে উচ্ছাস দেখানোর রীতি আছে তা রঞ্জন আর ভাস্বতী মানে না।তবে লোকটির কাছ থেকে রঞ্জন সিগারেট নিয়েছে বলে বলল আচ্ছা চলি তা হলে।
ভাস্বতীও লোকটির দিকে তাকায়।লোকটি ভাস্বতীর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে।যেন ভাস্বতীর রূপের ছটাকে গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।এতে ভাস্বতী বিরক্ত হয় না।একজন সুন্দরী নারীর এই বিষয়ে অভ্যেস আছে।
লোকটি হাত তুলে বলল আপনাদের আজ ফেরা হবে না।
রঞ্জন লোকটির দিকে তাকালো বলল কেন?
—-ঐ নদী পেরুতে পারবেন না।
—-আসবার সময় পেরিয়ে এসেছি।
লোকটি এবার শব্দ করে হাসলো।সেই হাসির শব্দ জঙ্গলে প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো।ভরাট গলার গমগম করতে থাকা হাসিটা মোটেই ভাস্বতীর ভালো লাগলো না।
লোকটি বলল আসা আর যাওয়া কি এক কথা?এসেই কি যাওয়া যায় সবসময়?
রঞ্জন সোজা কথার মানুষ।এই ধরণের হেঁয়ালি সে ঘৃণা করে।কোনো উত্তর না দিয়ে সে ভাস্বতীকে বলল চলো।
ভাস্বতী লোকটির কাছ থেকে পুনশ্চ বিদায় নেবার জন্য ভদ্রতাসূচকভাবে বলল আমরা আবার কাল কি পরশু আসবো।
রঞ্জন বলল ঠিক নেই।যদি সুযোগ সুবিধে হয়—
লোকটি বলল কালকের কথা কালকে।আজকের কথা ভাবুন।একটা শব্দ শুনতে পাচ্ছেন।
একটু কান পাতলেই ওরা শুনতে পেল ঝড়ো কলকল জলের শব্দ।
ভাস্বতী বলল এদিকে কি কোথাও জলপ্রপাত আছে?
—-নদীর শব্দ।আসবার সময় এরকম শব্দ শুনেছি।
রঞ্জনের কথার জবাবে একটু উগ্র ভাবেই লোকটি বলল না আসবার সময় এরকম শব্দ শুনতে পাননি।এতদূর থেকে নদীর শব্দ পাননি।
রঞ্জন বুঝতে পারে সত্যটা।
—-এরকম পাহাড়ী নদী বৃষ্টিতে ভরে যায়।কিন্তু এমন শব্দ!
লোকটা ভারিক্কি গলায় বলে ওঠে ও নদী এখন পার হতে পারবেন না।
রঞ্জন সাঁতার চ্যাম্পিয়ন।সে জলকে ভয় পায় না।ভাস্বতী সাঁতার জানে না সেকথা তখন তার মনে পড়ে না।একটু অবজ্ঞার সুরে বলে উঠল ও জল যতই বাড়ুক কিন্তু পার হওয়া যাবে না কেন?লোকে কি ভাবে পার হয়?
—-লোকে পার হয় না।
—-এখন দু’তিন দিন কেউ পার হতে পারবে না।এসব নদীতে নৌকাও চলে না।
রঞ্জন কিছু বলতে যাচ্ছিল, লোকটি বাধা দিয়ে বলল সাঁতার জানলে কিছু হবে না।স্রোতের টানে তিন চার মাইল দূরে গিয়ে উঠবেন।যদি পাথরে ঘা না লেগে মাথা না ফাটে।
—-গিয়েই দেখা যাক।
লোকটার কথা ভদ্র লোকের মত হলেও চেহারার বন্যতার মত সবসময় একটা আদিম ঔদ্ধত্য আছে।
একটু যেন নরম হল লোকটা।বলল আমি এ জায়গায় অনেকদিন আছি তো তাই আমি জানি।তাছাড়া আপনি ওই নদীটার নাম জানেন?
—-খাবারের দোকান দার বলেছিল বটে নামটা। কি যেন জিরে না কি যেন।নাম দিয়ে কি হবে?
—-নদীর নাম সবসময়ে জেনে রাখা জরুরী।
—কেন?
—-স্থানীয়র এই নদীর নামটাকে জিরুয়া বলে।আসল নাম জিরা।
—-জিরা অতি সাধারণ বাঙালি মশলা।কিন্তু জিরা ঝাঁঝালো হয়।জিরা নদী একবার পেরোলে কি আর ফেরা যায়?
নিজের রসিকিতায় লোকটি আবার হাসলো লঘু ভাবে।ভাস্বতীর ঠোঁটেও একটা হাসির রেখা দেখা গেল।এই অদ্ভুত ধরনের লোকটাকে তার খারাপ লাগছে না।সাধারণত অচেনা লোকদের পছন্দ করে না সে।সকলেরই কথা একঘেয়েমি বস্তাপচা হয়।সত্যিই এর নাম জিরা নাকি লোকেরা নদীটার নাম জিরা দিয়েছে নাকি এই বন্য’টার বানানো?
—-আপনি কে?
—-আমি জিরার ওপারের হলেও একজন সাধারণ মানুষ।
এই কথাটা বলার সময় তার মুখে একটা সুক্ষ হাসি ফুটে ওঠে।যেন সে এই সাধারণ মানুষ কথা দুটোতে বেশি জোর দিচ্ছে—এবং সে যেন দু’জন অসাধারন মানুষের সাথে কথা বলছে।
রঞ্জন ভ্রু কুঞ্চিত করলো।লোকটি বেশি বেশি হেঁয়ালি করছে।বৃষ্টির পরে এরকম বিপদসংকুল পরিস্থিতিতে হাসির কথা মানায় না।
ভাস্বতী জিজ্ঞেস করলো আপনি এখানে থাকেন বললেন, আপনি এখানে কি করেন?
লোকটি সংক্ষিপ্তভাবে বলল ব্যবসা করি।
তারপর ও আরো বিস্তারিত ভাবে বলল দেখুন না এই পাহাড়,জঙ্গলে আপনার মত কোনো মহিলার গলার আওয়াজ শোনা যায়নি।এই গাছগুলো,পাথরগুলো পর্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে আপনার কথা শুনছে।
ভাস্বতী গাছপালাগুলোর দিকে তাকালো।যেন সে ভক্তদের দেখছে।তার ভালো লাগে।
রঞ্জন বিরক্ত বোধ করলো।আজেবাজে কথা শুনে সে সময় নষ্ট করতে চায় না।লোকটির কাছে আরো কিছু জেনে নেওয়ার পর বলল নদী যদি পার না হওয়া যায় তবে এদিকে আর কোথাও থাকবার জায়গা নেই?
লোকটি সবজান্তার মত হাসলো।
—-খোঁজ খবর না করে আপনাদের আশা ঠিক হয়নি।বৃষ্টির সময়ে এদিকে কেউ আসেনা।আদিবাসীদের গ্রাম এখান থেকে ছয়-সাত মাইল দূরে।সেও নদী পেরিয়ে যেতে হয়।
—-কেউ কেউ আমাদের আসতে বারণ করেছিল।
—-কিন্তু আপনারা বিশ্বাস করেননি কেন? অশিক্ষিত গেঁয়ো লোকের কথা বিশ্বাস করা যায়না?কিন্তু তারাই প্রকৃতিকে সবচেয়ে বেশি জানে।
রঞ্জন বলল একটা ছোট নদী পার হওয়া তেমন কিছু কঠিন কাজ নয়।
—-কিন্তু এই বিশেষ নদীটি পার হওয়া শক্ত।
ভাস্বতী একটু রেগে গিয়ে বলল তাহলে কি এই নদী বৃষ্টিতে কেউ পারাপার করে না?
—-ভারতবর্ষে ক’টা নদীতে ব্রিজ আছে বলুন?
—-কোনো খেয়া পারাপার?
—-এরকম পাহাড়ী নদীতে খেয়াপারাপার করা যায় না।তাছড়া এই পাহাড়টিতে লোকে আসতে চায় না।
রঞ্জনকে চিন্তিত দেখাচ্ছিল।ভাস্বতী বলল ওপরের মন্দিরটায় লোকজন আছে?
—-কেউ নেই।
—-তাহলে মন্দিরটা আছে কেন?
—-এরকম থাকে
—-তাহলে আপনি কোথায় থাকেন?
—-মন্দিরে থাকি না।
ভাস্বতী রঞ্জনের দিকে তাকিয়ে বলল মন্দিরটা যদি খালি থাকে তাহলে আমরা রাত্তিরটা ওখানে কাটাতে পারি।
ভাস্বতীর মনে এডভেঞ্চার স্পৃহা জেগে উঠেছে।বাথরুমের ব্যাপার মনে নেই, কিন্তু জোঁক! তারা কি এত উপরে উঠবে।
রঞ্জন বলল এখানে জোঁক কিলবিল করছে।
লোকটি বলল এগুলো জোঁক নয়,কেঁচো।তবে সাপ প্রচুর আছে।
তবে সাপের নাম শুনলে অন্য কোনো মহিলা লাফিয়ে উঠতো।কিন্তু ভাস্বতীর মনে হল পাহাড়ী জঙ্গলে সাপ থাকবে তাতে আর আশ্চর্য্য কি!
—-চলো আমরা মন্দিরের দিকে যাই।
লোকটি বলল মন্দিরে এসময় ওঠা সম্ভব নয়।বৃষ্টির পর পাথর পিচ্ছল হয়ে আছে।
ভাস্বতী বলল ওঠা যায়নাতো ওপরে মন্দির বানালো কি করে?
—-ওঠা যায় না তো বলিনি।এমনিতেই শক্ত, এই বৃষ্টিতে একেবারেই ওঠা যায় না।
রঞ্জন মাঝপথে ওদের কথা থামিয়ে বলল সতী চলো তো আমরা ঠিক নদী পার হতে পারবো।
রঞ্জন হাঁটতে শুরু করলো।ভাস্বতী চলে এলো তার পাশাপাশি।লোকটিকে কিছু না বলা হলেও পাশাপাশি হাঁটতে লাগলো।মাথায় টুপিটা পরে নিয়ে চিমটে দিয়ে ঝোপঝাড়ে পেটাতে থাকলো।এমন ভাবে চলছে সে যেন তার নিজের কাজেই চলছে।
রঞ্জন একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো।চেহারাটা ভীষণ দীর্ঘ—লোকটির কোনো বদ মতলব নেই তো?এই পাহাড়ে একা একা একটি বাঙালি লোকের থাকা কেন?কিসের ব্যবসা?অবশ্য চেহারায় যা হোক ওর কথাবার্তায় একটা ভদ্রতার স্পর্শ আছে।
টগবগে ছল ছল করছে নদীর জল।কে বলবে এই নদী সেই–যে নদী একটু আগে রঞ্জন আর ভাস্বতী পার হয়ে এসেছে!অন্ধকার নেমে এসেছে,কোনো জনপ্রাণীর চিহ্ন নেই।
ভাস্বতী রঞ্জনের বাহু আঁকড়ে আছে।
রঞ্জন বলল তুমি আমাকে শক্ত করে ধরে আঁকড়ে থাকতে পারো।রিস্ক নিতে পারবে তো?
ভাস্বতী নিজে ঝুঁকি স্বভাবের মেয়ে।এডভেঞ্চার তাকে আকর্ষণ করে।ভয় পাওয়া তার চরিত্রে মানায় না।কিন্তু সাঁতার জানে না।তার রক্ত মাংস চামড়ার মত ভয় বাস্তব।এই ভয়ের কাছে সবাই একা।অতন্ত্য প্রিয়জনের পাশে থাকাও—সান্ত্বনা দেয় না।
লোকটি অল্প দূরে দাঁড়িয়ে আছে।তার মুখে অল্প অল্প হাসি।সম্প্রতি সে একটা গাছের ডাল ভেঙে নিল।ডালাপালা সমেত ছুড়ে দিল জলে।
মুহূর্তেই নদীটা গ্রাস করে নিল সেটাকে।আবার কিছুক্ষন পরে অনেকদূরে ভেসে উঠলো সেটা।স্রোতের টানে চলে যাচ্ছে দিশাহীন ভাবে।তারপর আর সেটাকে দেখা গেল না।ভাস্বতী এবার শিউরে উঠলো।
রঞ্জন হাতের ব্যাগটা নামিয়ে রেখে এক এক করে পোষাক খুলে ভাস্বতীর হাতে দিয়ে জাঙ্গিয়া পরা অবস্থায় নেমে পড়লো জলে।
কোমর জল পর্যন্ত নেমেই রঞ্জনের দুঃসাহস ডালটার মত অবস্থায় পরিণত হল।
ভাস্বতী চেঁচিয়ে উঠলো,এই—-।
লোকটি ক্ষিপ্র পায়ে দৌড়ে গেল।চিমটেটা বাড়িয়ে দিল।ধমকের সুরে বলে উঠলো করছেন কি—পাগলের মতন।
অনেক চেষ্টার পর চিমটেটা ধরে রঞ্জন উঠতে পারলো।বিপদে পড়লেও রঞ্জন ভয় পায়নি।কিছু দূর গিয়ে সে ভেসে উঠতোই।
ভাস্বতীর মুখখানা রক্তিম।মনে মনে সে অসহায় হয়ে পড়েছিল।অল্পক্ষনের জন্য রঞ্জন যেন মৃত হয়ে গেছিল তার কাছে।সে নিজেকে অপরাধী ভাবছিল।
লোকটি বিনম্র ভাবে এগিয়ে এসে বলল আজ রাত্তিরে আপনারা আমার অতিথি।আমার নাম রাজা সেন।
রঞ্জন বলল আমি রঞ্জন সরকার।আমার স্ত্রী ভাস্বতী গাঙ্গুলি সরকার।
তিনজনেই হাতজোড় করে নমস্কার বিনিময় করলো।তারপরে আর একবার পেছন ফিরে তারা তাকালো নদীটির দিকে।নদীর চরিত্র বড় দুর্বোধ্য।
ওরা এগিয়ে গেল পাহাড়ের সরু পথ বেয়ে।বড় পাথরটার আড়ালে লোকটার ঘর।
ফেরা পথটুকু দীর্ঘক্ষণ মনে হয়।রঞ্জন লোকটির সাথে কথা বলছে ভাস্বতী একা একা হাঁটছে আগে আগে।বৃষ্টি থেমে গেলেও এদিক ওদিক জল ঝরার শব্দ।পাহাড়ে নিস্তব্ধ আঁধারে কয়েকটা শালিখ পাখি কিচিরমিচির করে ফিরে যাচ্ছে।
এ পাহাড়ে বিশেষ কোনো ফুলের সমারোহ নেই।তবে একধরনের সাদা পাহাড়ী ফুলের পরগাছা মাঝে মাঝে ঝিলিক দিয়ে ওঠে।রাত্রে যখন এখানে থাকতেই হবে—এ সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে যাওয়ায় ভাস্বতীর মনে কোন জড়তা নেই।
—আপনি এখানে কতদিন আছেন?
—অনেক সময়।এই ধরুন দশ বছর।
—-দশ বছর! কি করেন আপনি?
—-আমি সাপ ধরার ব্যবসা করি।
পাহাড়ে এমনভাবে বাড়ী বানিয়ে থাকা অসম্ভব কিছু নয়।বিদেশের ছেলেমেয়েরা অনেকেই থাকে–রঞ্জন দেখেছে।হয়তো এদেশেও অনেকে রয়েছে,সে খবর রাখেনি।কিন্তু সম্পূর্ণ একা একা?
—আপনি কি কলকাতার?
লোকটি কি একটা যেন ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল।বলল উঁহু ত্রিপুরা।
বাড়ীটা তাঁবু ও কুঁড়েঘরের মাঝামাঝি।কাঠের ফ্রেমে তিনপাশে ত্রিপল লাগানো।শক্তপোক্ত কিছু গাছের কাঠ দিয়ে ঘেরা।পাহাড়ই একদিকের দেওয়াল।ওপরে টিন।ভাস্বতী এরকমই এক কুঁড়ে ঘরে হয়তো থেকে যাওয়ার বাসনা করেছিল।
ভিতরে দুটি কামরা।একটিতে দুটি ক্যাম্প খাট পাতা,টুকিটাকি জিনিসপত্র,একটি রাইফেল।পাশের ঘরে শুধু অনেকগুলি খাঁচা।
ঘরে ঢুকে লোকটি রেইনকোটটা খুলে ফেলার পর দেখা গেল,তার লম্বা দীর্ঘ চেহারা।তবে তা মেদহীন পেটানো ধাতুর মত শক্ত।মুখের মধ্যে সুশ্রী একটা ভাব হয়তো অনেক আগে ছিল।পাহাড়ে থাকতে থাকতে তা যেন রুক্ষ হয়ে গেছে।রেনকোটের তলায় সে শুধু পরেছিল ফুলপ্যান্ট আর স্যান্ডো গেঞ্জি।জামা-টামার বালাই নেই।হাতের বাইসেপ্স গুলো স্পষ্টতই দৃঢ় লোহার মত।
—-আপনাদের জামা কাপড়তো সব ভিজে গেছে।সঙ্গে আর কিছু আছে?
—-রাত কাটাবার প্ল্যান ছিল না।তাই সঙ্গে কিছু আনা হয়নি।
—-ভিজে পোশাক পরে তো থাকতে পারবেন না।আর আমার কাছে তো ধুতি-টুতিও কিছু নেই।কয়েকটা পাজামা আছে অবশ্য-তার দুটো পরে নিয়ে জামাকাপড়গুলো মেলে দিন, শুকিয়ে যাবে।
—-থাক না,তার আর দরকার নেই।
লোকটি বিছানার তলা থেকে দুটো পাজামা আর গেঞ্জি বার করে রঞ্জনের হাতে দিল।
বলল ইস্ত্রি না করা থাকলেও কাচা আছে ব্যাবহার করার কোনো অসুবিধে নেই।
—-আপনাকে খুবই অসুবিধেয় ফেললাম।
লোকটি পর্যায়ক্রমে দুজনের দিকে তাকিয়ে হাসলো।তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
লোকটি ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার পর ওরা দুজনে চুপচাপ হয়ে রইলো।ভিজে শরীরে কাঁপুনি দিচ্ছিল।দুজনে পরস্পরের অতি চেনা মানুষ,দু-এক মুহূর্ত যেন কথা খুঁজে পায় না।চোখ সরিয়ে নেয়।
ভাস্বতী বা রঞ্জন দুজনের কেউই অন্যের পোষাক পরা পছন্দ করে না।অথচ উপায় তো নেই।
ভাস্বতী একটু হালকা হেসে বলল আমি কি সারারাত এই পাজামা পরে থাকবো।
—-ভিজে শাড়ি পরে সারারাত থাকতে পারবে না।ঘন্টাখানেকের জন্য একটু মেলে দাও।যদি অল্প শুকিয়ে যায় পরে নিও।
ঘরের একটা দরজা আছে দরজাটা আলগা।পাশে রাখা আছে।রঞ্জন ওটা সরিয়ে এনে লাগিয়ে দিল।প্যান্ট,শার্ট,জাঙ্গিয়া,গেঞ্জি খুলে সেই পাজামা আর গেঞ্জি পরলো বিনা বাক্যব্যয়ে।চুপচাপ দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য দেখার পর ভাস্বতী শাড়িটা ছেড়ে ফেলল।সিল্কের শাড়ি জলে ভিজে বেজায় ভারী।মেলে দিলে শুকোতে বেশিক্ষন সময় লাগবে না।ব্লাউজটা খুলে ফেলার পর কালো সায়া আর কালো ব্রাতে ফর্সা শরীরটা মোহময় হয়ে উঠলো।যেন সে প্রাচীন মিশরের দেবদাসী।
ঘরের ভেতরটা আবছা অন্ধকার।ভাস্বতী রঞ্জনের কাছে এসে তার কাঁধের উপর দুই হাত রেখে বলল, তুমি রাগ করেছ?
-উই বিহেভড এজ ফুলস।কিছু না জেনেশুনে আমাদের এরকম আসা ঠিক হয়নি।
ভাস্বতী রঞ্জনের থুতনিটায় চুমু দিয়ে বলল এখন আর চিন্তা করে কি হবে।একটা তো থাকার জায়গা পাওয়া গেছে।
—-অচেনা লোকের কাছে থাকতে আমার ভালো লাগে না।
—-কত অচেনা জায়গায় তো আমরা থাকি।
—-সেখানে আমরা টাকা দিয়ে থাকি,হুকুম করি।সে জায়গা আর এ জায়গা কি এক?
ভাস্বতী ম্লান গলায় বলল এখন থেকে তুমি কি আমার ওপর সবসময় রাগ করে থাকবে?
—-তোমার ওপর রাগ করবো কেন?
—-হ্যাঁ করেছ তো।
রঞ্জন ভাস্বতীকে আলিঙ্গন করে বলল তুমি একদম কথা শুনলে না।আসবার জন্য যেভাবে জেদ ধরলে।
—-আমর কিন্তু বেশ ভালো লাগছে।
রঞ্জন ভাস্বতীর ঠোঁটে ঠোঁট জেঁকে দিল।ভাস্বতীর শরীরটা উষ্ণ।একটু-আধটু বিপদের গন্ধ পেলেই তার শরীরী চাঞ্চল্য বাড়ে।সে নিজের ঠোঁট রঞ্জনের ঠোঁটে পিষে দিতে লাগলো।
ব্রা পরিহিত কোমল রূপসী স্ত্রীকে আলিঙ্গন করে চুম্বন খেলা দীর্ঘক্ষণ করবার ইচ্ছে হলেও রঞ্জন করলো না।নিজের উষ্ণ স্ত্রীর কাছে একটু বিরতি পেয়ে বলল তাড়াতাড়ি করে নাও।ভদ্রলোক বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন।
ভাস্বতী তার অন্তর্বাসের বাঁধন খুলতেই আবছা আলোতে নগ্ন বক্ষদেশ দেখা গেল।সে সম্পুর্ন রকমের সুবিধাভোগীনি কারণ সে একটা নিখুঁত রকমের শরীর পেয়েছে।ভাস্বতীর উজ্জ্বল নগ্ন স্তনের আভায় উদ্বেলিত হচ্ছিল তার শরীর।সুন্দরী, বুদ্ধিমতী, দুঃসাহসী নারীর উদ্ধত বক্ষ হলে তা সম্পুর্ন নিখুঁতই বলা যায়।ভাস্বতী তেমনই উন্নত কোমল স্তনের অধিকারিণী।গোপন ব্লাউজের অন্তরালে তার হৃদয়স্পন্দন স্তনদ্বয়ের সাথে একাত্ম হয়ে থাকে।
সম্পুর্ন শরীরটা এগিয়ে গেল খাটের দিকে।এক এক করে পাজামা গেঞ্জি তুলে নিল,পরলো।
রঞ্জন চামড়ার ব্যাগ থেকে টর্চটা বেরকরে ভাস্বতীর গায়ে ফেলে বলল তোমাকে মজার দেখাচ্ছে।
টর্চের আলোর আভা পেয়ে লোকটি বাইর থেকে বলল ভেতরে একটা হ্যাজাক আছে জ্বেলে নিতে পারেন।
ভাস্বতী বলল আমি এইরকম ভাবে বেরুবো?
রঞ্জন বলল কি আর করা যাবে?গেঞ্জিটাও ফুটোফুটো।
ভাস্বতী ওদের বড় তোয়ালেটা গায়ে জড়িয়ে নিল।তার মুখে লজ্জার চিহ্ন নেই,রয়েছে কৌতুক।নিজের শরীরটা নিয়ে সে বিব্রত বোধ করে না কখনো।কিন্তু তার একটু ঠান্ডা লেগে গেছে এর মধ্যে—নাক সুলসুল করছে।
রঞ্জন দরজাটা খুলতে গিয়েও থেমে গেল–কি ভেবে রিভলবার সমেত কোমরে বেল্টটা জড়িয়ে নিল।তারপর দরজা খুলে বাইরে এলো।
লোকটা বাইরে বসে একটা স্টোভ জ্বালানোর চেষ্টা করছে।ভাস্বতী তাকে জিজ্ঞেস করলো আপনার কাছে অ্যাসপিরিন জাতীয় কিছু আছে?
মুখ না ফিরিয়ে সে বলল না।
তারপর ওদের পোশাক দেখে বলল কি আর হবে একটা রাত কষ্ট করে কাটিয়ে দেন।
—-কাল নদীর জল কমবে?
—-যদি বৃষ্টি না হয়।
—-আপনি এখানে একা থাকেন?
—-এখনো দ্বিতীয়জনকে কি দেখতে পেয়েছেন এই জঙ্গলে?আমার সাথে তবে থাকবেই বা কে?
ভাস্বতী জিজ্ঞেস করলো আপনার একা একা থাকতে খারাপ লাগে না?
লোকটা স্টোভটা জ্বেলে সেটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো।ভাস্বতীর মুখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে বলল আমাকে টারজান ভাববেন না।এ জঙ্গলের ছ মাইল দূরে আদিবাসী গ্রাম আছে ওরা আমায় চেনে।একশো তিরিশ কিমি দূরে ফরেস্টের অফিস।ওরা আমায় চেনে,জানে।আমার সাপ ধরার লাইসেন্স আছে।তাহলে আর একা কোথায়?
স্টোভটা নিয়ে ও দ্বিতীয় ঘরটাতে ঢুকে গেল।পেছন পেছন ওরাও এলো।একপাশে কতগুলো খাঁচা আর একটু রান্নার ব্যবস্থা।
—-ভাত চাপিয়ে দিচ্ছি।বিশেষ কিছু আতিথ্য করতে পারবো না,এজন্য দুঃখিত।
রঞ্জন বলল আমাদের কাছে পাউরুটি আর জেলি আছে।ভুলেই গেছিলাম।
ওগুলো এখন খেয়ে নিতে পারেন।রাতে ভাত, আলুসেদ্ধ আর পেয়াজ।ঘি আছে টাটকা।ডিম ছিল–ফুরিয়ে গেছে।
ভাস্বতী বলল ঘি আর গরম ভাত তো চমৎকার।
—-প্রত্যেকদিন খাবারের পক্ষে একঘেয়ে।তাছাড়া আর যখন কিছু নেই,তখন ভালো লাগুক আর খারাপ লাগুক—
—-আমাদের ভালো লাগবে।আমি কি আপনাকে রান্নায় সাহায্য করতে পারি?
—-সাহায্য করার কিছু নেই।আমি একসঙ্গেই ভাত আর আলু সেদ্ধ চাপিয়ে দেব–
হিসহিস শব্দ শুনে রঞ্জন চমকে গিয়ে বলল খাঁচা গুলোর মধ্যে কি সাপ আছে নাকি?
—-গোটা তিনেক আছে।ভয়ের কিছু নেই।খাঁচা ভালো করে বন্ধ আছে।দেখবেন?
টর্চের আলোয় দেখা গেল।দুটি সাপ নির্জীব হয়ে পড়ে থাকলেও একটি ফণা তুলে দাপাদাপি করছে।সেটা অন্তত হাত চারেক লম্বা,মাথার ওপর প্রবাদ মতন পায়ের ছাপ আঁকা।
—-এগুলো আপনি ধরেছেন?
—-হ্যাঁ
—-ভাস্বতী বকুনির স্বরে বলে উঠলো, এগুলো নিজে ধরেন কেন?সাপুড়ে কিংবা বেদেদের দিয়ে ধরতে পারেন না?
লোকটি বলল সাপুড়েরাই কেবল সাপ ধরতে পারে এটা পুরোনো ধারণা।কতগুলো টেকনিক আছে শিখে নিলেই হল।ধরবেন নাকি সাপ?
লোকটির শেষের কথাটির মধ্যে যেন একটা স্পর্ধার আদি রসিকতা আছে।ভাস্বতীর তবু খারাপ লাগলো না।মাঝপথে রঞ্জন বলে উঠলো কারা কেনে সাপ?
—-বোম্বের হপকিনস ইনস্টিটিউট।তাছাড়া দেশে বিদেশে নানা গবেষণাকেন্দ্র,চিড়িয়াখানা কেনে।
—-আপনি কি নিজেই যান ওদের কাছে।
—-না সরাসরি আমি বিক্রেতা নই।আসলে আমি সে অর্থে ব্যাবসায়ী নই।ভাস্বতীর দিকে তাকিয়ে বলল আমি একজন সাপুড়ে সে অর্থে বেদে।আমার কাজই সাপ ধরা।আমি চালান করি ভুবনেশ্বরে।সেখানকার কেন্দ্রের মাধম্যে বিক্রি হয়।