পর্ব ১৩
পরের দিন সকালে অনুরিমা দেখে তার ফোন সুচরিতার মেসেজ। সে বারবার অনুরিমাকে বোঝানোর চেষ্টা করছে সে বিশ্বাসঘাতক নয় , সে অনুরিমার কোনো বিশ্বাস ভাঙেনি। তার প্রাক্তন স্বামী অনুরিমার মতোই তার একজন বিশস্ত বন্ধু , যে কোনো কথা পাঁচকান করবে না , উপরন্তু সে সাহায্যই করবে। তাই সে সমীরের ব্যাপারটা আদিত্য কে জানিয়ে ছিল।
এরই মধ্যে অনুরিমার রাগ কিছুটা ঠান্ডা হয়েছিল। সে ভাবলো একবার তার বন্ধুর কথাটা তার শোনা উচিত। সে তাই সুচরিতাকে আবার মিট করতে বললো। কিন্তু এবার আদিত্যকে না নিয়ে আসার কথা কড়া ভাবে জানিয়ে দিলো। সুচরিতা রাজি হয়েগেলো তার এই শর্তে।
সেদিনই বিকেলে অনুরিমা আবার গেলো সুচরিতার সাথে দেখা করতে। সে যে দোটানার মধ্যে রয়েছে তাতে পারলে শত্রুকেও সে একবারের জন্য বিশ্বাস করতে পারে , সুচরিতা তাও তো ওর বান্ধবী ছিল , সেটাও আবার কলেজ জীবনের।
অনুরিমার সাথে দেখা হওয়া মাত্র সুচরিতা ওকে সব খুলে বলতে লাগলো। আদিত্য কৌতূহলবশত অনুরিমার সম্পর্কে ওর কাছে জানতে চেয়েছিলো। তখন ও আদিত্যকে সব খুলে বলে অনুরিমা এবং সমীরের সমস্যার ব্যাপারে। তখন আদিত্যও চায় অনুরিমার এই জীবনযুদ্ধে তার সৈনিক হতে। তাই সুচরিতা সেদিন তার প্রাক্তন স্বামীকে নিয়ে এসেছিলো অনুরিমার সাথে দেখা করাতে।
সুচরিতার যুক্তিতে অনুরিমা কিছুতেই কনভিন্সড হচ্ছিলো না। অনেকবার করে বোঝানোর পর ফাইনালি অনুরিমা মেনে নিলো সুচরিতার সব যুক্তি। কিন্তু একটা শর্তে , অনুরিমা না চাইলে বা অনুরিমাকে না বলে সুচরিতা আর কোনো কথা আদিত্য সেনগুপ্তকে বলবে না। তবেই অনু বিশ্বাস করে আবার সব কথা সুচরিতার সাথে শেয়ার করতে পারবে , নতুবা নয়। এই শর্তে সুচরিতা এক কথায় রাজি হয়েগেলো। এরপর জিজ্ঞেস করতে লাগলো কেন অনু তাকে আজ ডেকে পাঠালো , শুধুই কি তাদের মধ্যে সবকিছু শর্ট আউট করতে নাকি আরো কিছু কথা আছে যা বলার আছে।
অনুরিমা আস্তে আস্তে নিজের কথার বাক্স খুলতে লাগলো। সে বললো রাজীব তাকে কি কি করতে বলেছে। শুনে তো সুচরিতা অবাক ! মুখে হাত দিয়ে সে বসে পড়লো। ভাবতেই পারছে না , যে বান্ধবী তার কোনোদিন সমীর ব্যাতিত আর কারোর কথা কল্পনাতেও আনেনি , তাকে কিনা এখন অন্য পুরুষকে চুমু খেতে হবে তাও সেটা সমীরকে "সুস্থ" করার জন্য !
"আর ইউ সিরিয়াস ? তুই এটা পারবি করতে ?"
অনুরিমা খুব হেসিটেট ফীল করছিলো , কি বলে উঠবে বুঝে উঠতে পারছিলোনা। সুচরিতা অনুরিমার দ্বন্দ্ব অনুভব করতে পারছিলো। সে অনুরিমার হাতটাকে আলতো ভাবে ধরে বললো , "দেখ অনু , আমি জানি তুই এখন অনেক বড়ো ধর্মসংকটে পড়েছিস। এই পরিস্থিতিতে কোনো একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছনো তোর পক্ষে খুবই কঠিন। কিন্তু তুই যদি আমার সাজেশন চাস , তাহলে আমি বলবো , রাজীবের কথাটা তোর একবার ভেবে দেখা উচিত। ওর কথায় কিন্তু যুক্তি রয়েছে। সর্বোপরি ও একজন সেক্সওলজিস্ট, এসব ব্যাপারে তোর আমার থেকে ও বেশি বুঝবে। "
"কি গ্যারান্টি আছে সুচরিতা , যে রাজীব যা বলছে সেটা আমার আর সমীরের ভালোর জন্য। হতেই পারে এর পেছনে ওর কোনো অন্য উদ্দেশ্য আছে। "
"আমি বুঝতে পারছি , তুই ঠিক কি বলতে চাইছিস। আসলে দোষ তোর নয়। তুই ওর ব্যাপারে সবটা জানিসনা তাই এইভাবে ভাবছিস। কিন্তু আমি তো ওকে চিনি। আমি জানি ও এরকম ছেলেই নয়। ও খুব ভালো ছেলে , কিন্তু বেচারার জীবনে অনেক দুঃখ রয়েছে। "
"দুঃখ ! কিসের দুঃখ ?"
"রাজীব নিজের স্ত্রী মৌ-কে খুব ভালোবাসতো। ওদের লাভ ম্যারেজ ছিল। বিয়ের প্রথম কয়েকটা বছর খুব সুখেই কাটছিলো। কিন্তু ওদের জীবনে একটা শূন্যস্থান ছিল, ওদের বাচ্চা হচ্ছিলো না। রাজীব নিজের উদ্যোগে ডাক্তারের কাছে গিয়ে টেস্ট করে জানতে পারে যে সে সম্পূর্ণ সুস্থ ও সক্ষম। তার স্ত্রীয়ের মধ্যে কিছু সমস্যা রয়েছে যা চিকিৎসা করলে সেরে যাবে। ব্যাপারটা খোলসা করে সে মৌ-কে জানায়নি , পাছে সে দুঃখ পায়। সে বলতো সমস্যা একটা রয়েছে দুজনের যা চিকিৎসার মাধ্যমে নিরাময় সম্ভব। কিন্তু মৌ ভাবতো সমস্যা বুঝি শুধু রাজীবের রয়েছে , নিজের অক্ষমতা ঢাকতে সে এই সমস্যাকে ভাগ করে নিতে চাইছে। প্রথম প্রথম মৌ এসব নিয়ে কিছু বলতো না। কিন্তু একদিন হঠাৎ রাজীব জানতে পারে তার আদরের মৌ তার সাথে প্রতারণা করছে। সে তার অফিসের এক কলিগের সাথে পরকীয়াতে জড়িয়ে পড়েছে। রাজীব তারপরেও চেষ্টা করেছিলো নিজের বিয়েটাকে বাঁচানোর। কিন্তু ওর স্ত্রী নাছোড়বান্দা ছিল। রাজীবের নামে সে মিথ্যে অভিযোগ আনতে লাগলো। বললো রাজীব নাকি ইম্পোটেন্ট , সে তার স্ত্রীকে সন্তুষ্ট করতে অক্ষম , আর এই মিথ্যে কথাটা সে রটিয়ে দেবে। লোকলজ্জার ভয়ে তাই রাজীব বাধ্য হয় মৌ কে নিঃশর্ত ডিভোর্স দিতে। কিন্তু রাজীব তো জানতো তার মধ্যে কোনো অসুবিধা ছিলোনা। তার স্ত্রী তার ভালোমানুষির সুযোগ নিয়ে তাকে জাস্ট ব্ল্যাকমেইল করেছিল সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসার জন্য। এরপর রাজীব সেক্সওলজি নিয়ে পড়াশুনা করতে লাগলো। ও প্রথমে একজন জেনারেল মেডিসিনের ডক্টর ছিল। তারপর সেখান থেকে স্ট্রিম চেঞ্জ করে সেক্সওলজি বিভাগে চলে এলো। যাতে ওর মতো আর কোনো স্বামীকে এরকম সমস্যার মুখোমুখি না হতে হয়। ও যদি মেডিসিনের ডাক্তারিটা চালিয়ে যেত তাহলে আজ না জানি কতদূর পৌঁছে যেত। যৌন বিষয়ে কথা বলতে ক'জনই বা আসে। সবাই যে লোক লজ্জার ভয় পায়। কিন্তু তবুও রাজীব সেক্সওলজির ক্লিনিকই চালায়। আশা করছি এবার তোর ওকে নিয়ে সব ডাউট ক্লিয়ার হয়েছে ?"
সব কথা শুনে অনুরিমা মাথা নিচু করে বললো , "আমি জানতাম না ওনার জীবনে এতো কিছু ঘটে গ্যাছে ", মনে মনে অনুরিমার একটু খারাপ লাগলো , রাজীবকে নিয়ে স্বল্প সিমপ্যাথির উদয় হলো।
"তাই তোকে বলি , আগে থেকে কারোর ব্যাপারে কোনো জাজমেন্ট দিয়ে বসিস না। এই যেমন তুই আদিত্যকেও ভুল বুঝলি। সেও কিন্তু শুধু তোর হেল্প করতেই চেয়েছে। ওর সাথে আমার বিয়েটা টেকেনি ঠিকই ফর সাম ফ্যামিলি ইস্যুস, কিন্তু তবুও বলবো মানুষ হিসেবে ও সত্যি অতুলনীয় , এখনও তাই ওকে মনে মনে আমি খুব রেসপেক্ট করি।"
অনুরিমা আর কিচ্ছু বুঝতে চাইছিলো না। ওর মাথা হ্যাং হয়েগেছিলো এতো ভাবনার যানজটে। সে মাথায় হাত চেপে বসেছিলো। সুচরিতা ওকে সময় দিচ্ছিলো নিজের ভাবনাগুলো কে একের পর এক সাজিয়ে সেই যানজটকে মুক্ত করার। অবশেষে অনুরিমা মুখ খুললো। .......
"তাহলে তুই কি অ্যাডভাইস করছিস ?"
"আমি রাজীবকে ভালোমতো চিনি। ও খুব বিশ্বস্ত ছেলে। আমার মনে হয় ওর সবকথা তোর অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলাটাই একমাত্র অপশন। ও যদি এখন তোকে জলে ঝাঁপও দিতে বলে তাহলেও তোর সেটাই করা উচিত। ওর উপর বিশ্বাস করে দেখ , ঠকবি না। "
সেদিনের মতো অনুরিমা ও সুচরিতার মধ্যেকার বাক্যালাপ শেষ হলো। অনুরিমা বাড়ি ফিরে এলো , আর ভাবতে লাগলো তার পরবর্তী পদক্ষেপ কি হওয়া উচিত। অনেক ভাবনা চিন্তা করার পর সে নিজের ফোনটা হাতে নিলো , নিয়ে রাজীবকে কল দিলো। রাজীব ধরলো , ফোনটা।
অনুরিমা বুকে পাথর চাপা দিয়ে রাজীবকে বললো সে সব শর্তে রাজি আছে। রাজীব যা যা বলবে অনুরিমা তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে , তাতে যদি তার স্বামী পূনরায় স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারে তাহলে তাই ঠিক। রাজীব তাকে আরেকদিন দেখা করতে বললো। জানালো তাদের "রিহার্সাল" খুব শীঘ্রই শুরু করতে হবে নাহলে অনেক দেরী হয়ে যাবে সমীরকে মূলস্রোতে ফেরাতে। অনুরিমা রাজীবকে অনুরোধ করলো এসব যতোটা সম্ভব কম করার চেষ্টা করতে , কারণ সে সমীরের পতিব্রতা স্ত্রী , তাকে এসব কাজ শোভা পায়না। পাঁকে পড়ে সে এসব করতে বাধ্য হচ্ছে। রাজীব ফোনে আশ্বাস দিয়ে বললো কমল তো পাঁকেই ফলে। গায়ে কাদা না মাখলে আগামী দিন পদ্মের ন্যায় সুশোভিত হবে কি করে ! রাজীবের ইঙ্গিত বুঝতে অনুরিমার অসুবিধা হলো না। সে ইতিবাচক সম্মতি দিয়ে ফোন রেখে দিলো।
সেই সপ্তাহের শনিবার রাজীব তাদের আসতে বারণ করে দিলো। জানতো যে এসেও কোনো লাভ নেই। যেই সমাধান সে বার করেছে তার জন্য আগে অনুরিমাকে তৈরী হতে হবে। তার আগে সমীরের সাথে সিটিং করে কি হবে। অনুরিমা কে রাজীব অনুরোধ করলো তাদের পরিকল্পনার সম্পর্কে সমীরকে কিছু না জানাতে , খানিকটা কাউন্সেলিং এর স্বার্থেই। কিন্তু অপরদিকে রাজীব সমীরের সাথে আলাদা ভাবে ফোনে কথা বলে রেখেছিলো ! কবে কোথায় সে অনুরিমার সাথে দেখা করবে সব ডিটেইলস সমীরকে আগাম দেবে বলে আশ্বাস দিয়ে রেখেছিলো !
আসলে রাজীব তখন ডাবল গেম খেলছিলো, তাদের স্বার্থেই। রাজীব অনুরিমাকে যথা সম্ভব সেক্সচুয়ালি ওপেন করার চেষ্টা করছিলো , অপরদিকে সমীরকে কিছুটা হলেও কাকোল্ড অভিজ্ঞতার স্বাধ দেওয়ার চেষ্টা করছিলো। যাতে দুদিকটাই বজায় থাকে। এর মাধ্যমে সে নিজের সেই থিওরির উপরই কাজ করছিলো , যেখানে দুজন দুই বিপরীত প্রান্তে দাঁড়িয়ে , দুজনকে একত্রে মধ্য বিন্দুতে নিয়ে আনতে হবে। এক কথায় শিয়ালদাহ আর নিউ জলপাইগুড়ির ট্রেন দুটিকে ফারাক্কায় নিয়ে আসার ব্যাপার।
আসলে ফ্ল্যাশব্যাকে গেলে বোঝা যাবে যে রাজীবের বাজপাখির নজর থেকে সেদিন সমীর লুকোতে পারেনি। ভিক্টোরিয়ায় সে যতোই ছদ্মবেশে যাক , অনুরিমা না পারলেও রাজীব ঠিক সমীরকে চিনতে পেরেছিলো। তখন কিছু না বললেও পরে ফোন করে রাজীব সেই কথা সমীরকে জানায়। ধরা পড়ে সমীর বাধ্য হয় স্বীকার করতে যে সে ভিক্টোরিয়ায় নিজের স্ত্রী ও রাজীবের উপর গুপ্তচরবৃত্তি করতে গেছিলো, সন্দেহের বশে নয় , তবে কৌতূহলবশে। রাজীব বুঝতে পারে সমীর তার কাকোল্ড ফ্যান্টাসির তাড়নায় এসব করেছিলো। রাজীব তখন সমীরকে আশ্বাস দ্যায় যে তার গোপনে তার স্ত্রীয়ের সাথে সে কোনো অভিসারে লিপ্ত হবে না। যা করবে , বা যদি কিছু করার থাকে তাহলে সেটা সমীরকে সাক্ষী রেখেই করবে।
এরপর শুরু হয় রাজীবের পরবর্তী পরিকল্পনা। সে অপেক্ষা করতে থাকে অনুরিমার ফোন কলের। এর মাঝে অনুরিমা সুচরিতার কাছে পরামর্শ নিতে যায়। তারপর অবশেষে অনুরিমা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে সে রাজীবের সব কথা মানবে , সমীরকে ঠিক করার স্বার্থে। তাই সে বহুকাঙ্খিত ফোন কলটি করেই ফেলে রাজীবকে এবং বলে সে রাজি , রাজীবের সব কথা মেনে চলতে।