- 1,461
- 2,214
- 159
পর্ব ১৮
"চলুন , তবে যাওয়া যাক ", অনুরিমাকে আদিত্য বললো।
"হ্যাঁ হ্যাঁ , চলুন ", বলে অনুরিমা আদিত্যর সাথে বেরোতে লাগলো।
আদিত্য গাড়ি স্টার্ট দিলো। মেঘ ঘনিয়ে কালো হয়ে এসছিলো। হঠাৎ করে মেঘ ডেকে উঠলো। অনুরিমা ভয় পেয়ে বললো , "একটু তাড়াতাড়ি চলুন , দেখছেন তো মেঘের কি অবস্থা। সুচরিতা ঠিকই বলেছে , কলকাতার রাস্তায় বাস অটো ট্যাক্সির কোনো মা বাপ্ নেই , কখন যে এরা ভিন্ন ভিন্ন কারণে ঝাঁপি বন্ধ করে দ্যায় তার ঠিক নেই , তা কোনো রাজনৈতিক কারণে হোক বা প্রাকৃতিক কারণে। "
"চিন্তা করবেন না ম্যাডাম , আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব যখন কাঁধে নিয়েছি তখন হাজার বিপর্যয় এলেও আপনাকে ঠিক আমি বাড়ি পৌঁছে দেবো। "
"আমি কথাটা ঠিক ওভাবে বলতে চাইনি। আসলে আপনাকেও তো বাড়ি ফিরতে হবে , আকাশ দেখে মনে হচ্ছে প্রবল বৃষ্টি নামবে। আর অতো বৃষ্টির মধ্যে গাড়ি চালানোটা সেফ নয়। তাই বলছিলাম , যদি আপনি বৃষ্টি নামার আগেই নিজের গন্তব্যে পৌঁছে যান তাহলে সেটা আপনার পক্ষেই ভালো হবে। আমি এসে শুধু শুধু আপনার হেডেক বাড়ালাম। "
"মোটেই না। তুমি হয়তো জানোনা , আমি অনেক এক্সপিরিয়েন্সড ড্রাইভার , সেই কলেজ লাইফ থেকে ড্রাইভিং করি নিজের কার। আমার এই বৃষ্টি বাদলের দিনে বরং ড্রাইভিং করতে ভালোই লাগে , বেশ রোম্যান্টিক একটা ব্যাপার থাকে। ..... বাই দা ওয়ে , আমি তোমাকে তুমি করে ডাকলে অসুবিধা নেই তো ? "
"না না , ঠিক আছে। আমি আপনার থেকে বয়সে এমনিতেও অল্পবিস্তর ছোট , তাই তুমি করে ডাকতেই পারেন। "
"তাহলে তো , তোমাকেও তুমি করে ডাকতে হবে আমায়। সো নো আপনি , ওকে ?"
"আচ্ছা সব ছেলেরাই কেন আপনি থেকে তুমি ডাকটা শুনতে বেশি পছন্দ করে ? "
"এই আবদার বুঝি আগেও অন্য কোথাও থেকে আপনার কাছে এসছে ?"
"আলবাত। ...."
"তা সেই ডাকে কি মিস অনুরিমা সাড়া দিয়েছিলো ?"
"সেটা বড়ো কথা নয় , আগে আমার প্রশ্নের উত্তরটা দেওয়া হোক। ...."
"বাকি ছেলেদের কথা তো বলতে পারবো না , বাট আমি তুমি ডাকটাই বেশি প্রেফার করি , সম্বোধন করতেও আর পেতেও। তাই অফিসের জুনিয়ররাও আমাকে তুমি করে ডাকে , আমিও তাদের তুমিই বলি , উভয় লিঙ্গ বিশেষে ...."
"বুঝলাম , তা এটা কেন ভাবলে যে আমিও সমান সাচ্ছন্দ বোধ করবো ?"
"আমি অতো ভাবিনা , এই যেমন তুমি না ভেবেই আমাকে তুমি করে সম্বোধন করা শুরু করলে , এক্ষুনি বলে উঠলে ভাবলে ইনস্টেড অফ ভাবলেন ......"
"সাবকনশাস মাইন্ডে বলেছি , সেটাও অবজার্ভ করলেন ?"
"সে তুমি যেই মাইন্ডেই বলে থাকো না কেন , যখন বলেই ফেলেছো আর ব্যাক আউট করোনা। তুমিতে স্টিক থাকো। "
"আপনি খুব জেদি দেখছি , সরি তুমি .... হয়তো এই জেদের কারণেই সুচরিতার সঙ্গে সম্পর্ক থাকেনি আপনার , সরি এগেইন , তোমার। ....."
সঙ্গে সঙ্গে আদিত্যর মুখের অভিব্যক্তি বদলে গেলো। সে খানিকটা কড়া গলায় বললো , "তুমি আদেও জানো , কেনো আমার আর সুচির সম্পর্ক ভেঙে গেছিলো ? তুমি হয়তো সুচির ভার্শনটা শুনেছো , আর সেটাকেই সত্যি ভেবে আমাকে এখন অ্যাকিঊস্ করছো ! আমি খারাপ , আমার মা খারাপ , আর তোমার সুচিই একমাত্র ভালো , তাই তো ??"
আদিত্যর গলার আওয়াজে হঠাৎ কঠোরতার প্রকাশ শুনে অনুরিমা বুঝলো দ্যাট সি হ্যাস ডান দা মিস্টেক বাই ক্রসিং হার লিমিট। সে অনুনয় বিনয় করে আদিত্যর কাছে দুঃখ প্রকাশ করতে লাগলো। বোঝাতে লাগলো তার কোনো উদ্দেশ্য ছিলোনা আদিত্যকে হার্ট করার। কিন্তু আদিত্য অতো সহজে মানতে চাইছিলো না। বোঝাই যাচ্ছিলো না জেনে অনুরিমা তাকে অনেক গভীরে আঘাত করেছে। আদিত্য অনুরিমার সাথে কথা কাটাকাটি করতে গিয়ে স্টিয়ারিং থেকে তার মন সরে যায়। ব্যাস , আর কি ! নজর হাটি তো দূর্ঘটনা ঘটি। তাদের সাথেও ঠিক সেটাই হলো। ভুলবশত গাড়িটা গিয়ে ধাক্কা খেলো একটা ল্যাম্প পোস্টে।
ভাগ্য ভালো তাদের দুজনের কোনো আঘাত লাগেনি। কিন্তু অ্যাক্সিডেন্ট দেখে দূর থেকে সাদা ইউনিফর্ম পড়া কলকাতা ট্রাফিক পুলিশের সার্জেন ছুটে এলো। পথচলতি প্রাইভেট গাড়ির এরকম বিপর্যয়ের মতো সুযোগ কি আর সার্জেনরা ছাড়ে। তাঁরা তো বসেই আছে লম্বা চালান কাটার জন্য আর সাধারণ মানুষদের হ্যারাস করার জন্য।
একজন অফিসার দৌড়ে এলো তাদের কাছে। আদিত্যর সাথে বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়লো। অনুরিমা তা দেখে একটু ভয় পেয়ে গেলো। সে আদিত্যকে থামানোর চেষ্টা করছিলো। কিন্তু আদিত্য কোনো কথা শুনছিলোনা। সে ক্রমাগত পুলিশ অফিসারটার সাথে হিটেড আর্গুমেন্ট করে যাচ্ছিলো। ফলে যা হওয়ার তাই হলো , আদিত্যর একটা লম্বা চালান কেটে গেলো। তাছাড়া যেমন ঘোড়া দেখলে মানুষ খোড়া হয় তেমনই দামী গাড়ি দেখলে পুলিশেরও ট্রাফিক নিয়মের কথা বেশি মনে পড়ে। পুলিশ অফিসার আদিত্যকে তার সাথে থানায় যেতে বললো। আদিত্য রাজি হলোনা , তো অফিসার তার গাড়িকে জব্দ করলো, বললো থানা থেকে ছাড়িয়ে আনতে। আদিত্য বললো , তাই হবে। কিন্তু এখন সে থানায় যেতে পারবে না, পরে গিয়ে ছাড়িয়ে আনবে গাড়িটা। কারণ তার কাছে এখন গাড়ির চেয়েও অনেক বেশি গুরুত্ব এই মেয়েটিকে (অনুরিমার দিকে আঙ্গুল করে বললো) এই আবহাওয়ায় নিরাপদে তার বাড়ি পৌঁছে দেওয়া। কথাটা শুনে আদিত্যর প্রতি অনুরিমার মনে শ্রদ্ধার জায়গা তৈরী হলো।
কথামতো অফিসার আদিত্যর কাছ থেকে চাবি নিয়ে গাড়িটাকে সরকারী ভাবে দখল করলো। অনুরিমা ও আদিত্য এবার হাঁটা দেওয়া শুরু করলো। অনুরিমা বারবার আদিত্যকে বলছিলো তার এটা করা উচিত হয়নি , তার এখন গাড়িটাকে রেসকিউ করা নিয়ে ভাবা উচিত ছিল। অনুরিমা ঠিক কিছু না কিছু একটা ম্যানেজ করে বাড়ি পৌঁছে যেত। আর আদিত্যও প্রত্যুত্তরে বারবার এটাই বোঝাচ্ছিলো যে সে কখনোই কোনো মেয়েকে এভাবে মাঝরাস্তায় ফেলে এক পার্থিব বস্তুর পিছনে দৌড়োবে না।
আদিত্যর এসব কথা গুলো অনুরিমাকে একটা ফীল গুড ব্যাপার অনুভব করাচ্ছিল। সে এবার আদিত্যর সাথে অনেক বেশি সহজভাবে কথা বলতে পারছিলো। রাজীবের মতো সেখানে কোনো ট্রিটমেন্টের বাধ্যবাধকতা ছিলোনা। মনে মনে অল্প অনুশোচনাও বোধ হচ্ছিলো এটা ভেবে যে আদিত্য ও সুচরিতার অতীতের বৈবাহিক সম্পর্ক নিয়ে তার ওইরূপ আলটপকা মন্তব্য করা উচিত হয়নি। কিন্তু সে তো শুধু তাই বলেছে যা সে সুচরিতার কাছ থেকে জেনেছে। তাহলে কি সুচরিতা তাকে নিজের ম্যারেড লাইফ নিয়ে ভুল কথা বলেছিলো ? দুই তরফের কথা না শুনে কখনো কোনো জাজমেন্টে আসা উচিত হয়নি তার।
সেই সময়ে অনুরিমার খুব জানতে ইচ্ছে করছিলো কেন আদিত্যর সাথে তার বান্ধবীর বিয়েটা টেকেনি ? এই কথা তো ঠিক যে আদিত্য নিঃসন্দেহে একটা ভালো ছেলে , তার প্রমাণ সে আজ পেয়েছে। তাছাড়া তার প্রাক্তন স্ত্রী সুচরিতাও সবসময়ে তার এক্স-হাসবেন্ড কে নিয়ে যতবার কথা বলেছে ভালো ভালো কথাই বলেছে , যা সত্যিই খুব বিরল ব্যাপার। বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পরও কোনো মেয়ের তার প্রাক্তন স্বামীকে নিয়ে এতোটা রেসপেক্টফুল থাকা , সচরাচর দেখা যায়না। তাই স্বাভাবিকভাবেই মানুষ আদিত্যকে নিয়ে অনুরিমার কৌতূহল ক্রমশ বাড়ছিলো।
সে আদিত্য ও সুচরিতার বিয়ে নিয়ে কথা তুলতেই যাবে কি সঙ্গে সঙ্গে ঝমঝম করে বৃষ্টি নেমে আসলো। তারা তখন এমন একটা জায়গায় ছিল যেখানে কোনো শেড ছিলোনা বৃষ্টি থেকে বাঁচার। এভাবে হঠাৎ করে প্রবল বেগে বৃষ্টি নেমে আসবে সেটা তারা ভাবতে পারেনি। তাদের কাছে ছাতাও ছিলোনা। অনুরিমা প্যানিক করে গিয়ে দৌড়ে কাছের একটি বাস স্টপ ছাউনিতে যেতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে গেলো। আদিত্য অনুরিমা বলে চেঁচিয়ে উঠলো। রাস্তা তখন শুনশান , আসে পাশে কেউ নেই সাহায্য করার। গাড়ি থেকে শুরু করে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট সব নিজের গতি বাড়িয়ে ছুটছিলো , বৃষ্টিতে নিজ নিজ গন্তব্যে তাড়াতাড়ি পৌঁছনোর জন্য। কারোর সময় নেই থামার।
আদিত্য সঙ্গে সঙ্গে অনুরিমাকে কোলে তুলে নিয়ে কাছের সেই বাস ছাউনিতে এসে বসালো। যন্ত্রণায় অনুরিমা কাতরাচ্ছিল। হাত পা বেশ ছিলে গেছিলো , রক্ত বেড়োচ্ছিলো। ব্যাথায় অনুরিমার চোখ দিয়ে জল বেড়িয়ে আসছিলো। আদিত্য মাথা ঠান্ডা রেখে প্রথমে দেখলো কোথায় কোথায় অনুরিমার লেগেছে। তারপর অনুরিমাকে বসতে বলে বৃষ্টি মাথায় নিজে বেড়িয়ে পড়লো কাছে পিঠে কোনো ওষুধের দোকান আছে কিনা সেটা খুঁজতে। বিধাতার অশেষ কৃপায় পেয়েও গেলো একটা কেমিস্টের দোকান। দোকানে গিয়ে তাড়াতাড়ি একটা ফাস্ট-এইড্ এর বক্স কিনলো , সঙ্গে কিছু নেসেসারি ওষুধপত্র যেমন পেইন কিলার ইত্যাদি। সেসব নিয়ে সে আবার ছুট দিলো অনুরিমার উদ্দেশ্যে।
বাস স্টপে পৌঁছে আদি ফাস্ট-এইড বক্স এর সাহায্যে অনুরিমার সাময়িক শুশ্রুষা করতে লাগলো। বন্ধু নয় , যেন স্বামীর কর্তব্য সে পালন করছিলো। আদিত্যর বিরামহীন যত্নে অনুরিমার একটু আরাম অনুভব হচ্ছিলো। সে মনে মনে সমীরকে কল্পনা করছিলো কিন্তু বাস্তবে সেই কার্য আদিত্য করছিলো। যখন সে সেটা বুঝতে পারলো তখন সে নিজেকেই প্রশ্ন করলো যে সমীর কি কোনোদিনও তার এভাবে যত্ন নিয়েছে , যতটা যত্ন একটা অজানা অচেনা পুরুষ কয়েকদিনের আলাপেই নিচ্ছে। সে চাইলেই তো নিজের গাড়ির পিছনে ছুটতে পারতো ! তা না করে সে আমার সাথে এলো , একসাথে বৃষ্টিতে ভিজলো। ভিজতে ভিজতে আমার জন্য ওষুধ আনতে গেলো। এখন আমার শুশ্রুষা করছে। ইস্সস ! কত ভালোই না হতো যদি এসবকিছু আদিত্যর বদলে সমীর করতো।
মনে মনে অনুরিমা বলে উঠলো , "সমীর তুমি কোথায় ? বারবার কেন এমন হয় , যে যা আমি তোমার কাছ থেকে এক্সপেক্ট করি তা আমাকে অন্য কেউ দিয়ে যায়। আমি তো এসব কিছু তোমার কাছ থেকে চাই। তোমার সাথে বৃষ্টিতে ভিজতে চাই , তোমার সাথে ফাঁকা সিনেমা হলে চুম্বনে লিপ্ত হতে চাই , আর তুমি কিনা আমাকেই অন্য কারোর সাথে কল্পনা করো , ছিঃ !"
মনে মনে এসব ভেবে অনুরিমা কেঁদে উঠলো। আদিত্য ভাবলো এটা তার শারীরিক ব্যাথার কান্না , যে ব্যাথা সে কিছুক্ষণ আগে পড়ে গিয়ে পেয়েছে। কিন্তু না , এ ব্যাথা তো আসলে মনের। জীবনে অপূরণীয় আকাঙ্খা নিয়ে অনুরিমার কোনো অভিযোগ নেই। অভিযোগ তার এটাই যে সেইসব অপূরণীয় আকাঙ্খা তার পূরণ হচ্ছে অন্য পুরুষদের দিয়ে , তার স্বামীর দ্বারা নয়। সেটা তাকে আরো ব্যাথিত করে তুলছে।
বৃষ্টি ভেজা মুখেও অনুরিমার চোখের জল বুঝে নিতে আদিত্যর অসুবিধা হয়নি। সে ঠিক বুঝতে পারছে অনুরিমা কাঁদছে। তাই সে খুবই নরম গলায় আদরভরা স্নেহে জিজ্ঞেস করে উঠলো , "ব্যাথা করছে ?"
ভাবনার আকাশে মেঘ সরে গিয়ে সে বাস্তবতার আলো দেখতে পেলো। নিজেকে সামলে নিয়ে অনুরিমা বললো , "হ্যাঁ , ওই একটুখানি।"
অনুরিমা আদিত্যকে বুঝতে দিলোনা তার চোখে জলের পিছনে আসল কারণ। বৃষ্টিটা তখন একটু লেগে এসছিলো। তবু রাস্তা ছিল কাঁদাময় , এবং ফুটপাথ শ্যাওলাময়। অনুরিমা আদিত্যর হাত ধরে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলো। উঠতে পারলো , কিন্তু চলতে পারছিলো না তখন। আদিত্য বললো এখন আবার পা পিছলে পড়লে সে আর উঠতেও পারবে না। এই বলে আদিত্য কিছু জিজ্ঞেস না করেই অনুরিমাকে নিজের কোলে তুলে নিলো। অনুরিমা অবাক হয়েগেলো। আদিত্য কোলে করে তাকে কোথায় নিয়ে যাবে ? বাড়ি যে এখনও অনেক দূর।
রাস্তাটা তখনও বেশ ফাঁকাই ছিল। দু-চারজন লোক বেরিয়ে ছিলো। কিন্তু তাদেরও তো চোখে পড়ছিলো যে ফুটপাথ দিয়ে বৃষ্টি ভেজা রাস্তায় একটা ছেলে একটি মেয়েকে সিনেমার মতো কোলে তুলে নিয়ে কোথাও একটা যাচ্ছে। অনুরিমা লজ্জায় ছটফট করতে লাগলো। আদিত্যকে অনুরোধ করতে লাগলো তাকে নামিয়ে দেওয়ার জন্য। আদিত্য তাকে ওয়ার্নিং দিলো , এরকম করলে অনুরিমা নিজেও পড়বে তাকেও ফেলবে। তারপর দুজনের কোমড় ভাঙবে। তখন কে কাকে সাহায্য করবে ? সে যা করছে তা অনুরিমার ভালোর জন্যই করছে। এই অবস্থায় অনুরিমা ভেজা পিচ্ছিল রাস্তায় হেঁটে যেতে পারবে না। পরিস্থিতিটা একটু অনুরিমা বোঝার চেষ্টা করুক।
অনুরিমা তখন জিজ্ঞেস করলো এইভাবে সে তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে ? বাড়ি তো এখন অনেক দূর ! আদিত্য বললো ওষুধ আনতে গিয়ে সে একটি ইন্ লজ দেখে এসছে। এখন তারা সেখানে যাচ্ছে। এভাবে বাস স্টপে কতোক্ষণ আর বসে থাকবে ! কোনো বাস পাওয়া যাচ্ছে না, পেলেও সেই বাসে খুব ভীড় থাকবে , যেখানে অনুরিমা চাইলেও উঠতে পারবে না এই পা নিয়ে। সব ট্যাক্সি নিজেদের মিটার বন্ধ করে গাড়ি গ্যারেজ করে দিয়েছে। তাই এখন হেঁটে হেঁটেও বাড়ি ফেরা যাবেনা। তার চেয়ে বরং একটি লজে কিছুক্ষণ স্টেই করে অনুরিমা বিশ্রাম নিক। ব্যাথা কিছুটা ঠিক হলে , এবং রাস্তায় গাড়ি চলাচল স্বাভাবিক হলে তখন কোনো শাটল্ বা গাড়ি ভাড়া করে আদিত্য অনুরিমাকে নিরাপদে বাড়ি পৌঁছে দেবে।
আদিত্যর সাথে কোনো লজে সময় কাটাতে তার মন তো চাইছিলো না , কিন্তু আর তো কোনো উপায়ও ছিলোনা। আদিত্যর অকাট্য যুক্তিকে কোনো এক্সকিউস দিয়ে খণ্ডন করা যাচ্ছিলো না। সে ভাবলো একবার সমীরকে ফোন করে আসতে বলবে। সেই মতো অনুরিমা তার ছোট হ্যান্ডব্যাগ থেকে ফোনটা বার করলো। ওমাহঃ ! দেখলো তখন পড়ে যাওয়ার সময়ে ব্যাগ সমেত ফোনটা জলে পড়ে যাওয়ায় ফোনটা ডেড হয়েগেছে ! শিট্ ! বিপদ যখন আসে তখন চারদিক থেকে সকল বিপদ একসাথে গ্যাং আপ করেই আসে। একবার ভাবলো যে আদিত্যর কাছে ফোন চেয়ে সে সমীরকে কল করবে। কিন্তু আদিত্য কি ভাববে ? আদিত্য ভাববে যে অনুরিমাকে তাকে বিশ্বাস করছে না ! একেই সে তার আর সুচরিতার বৈবাহিক সম্পর্ক নিয়ে দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য করে যথেষ্ট লজ্জিত , আর সে নিজেকে ছোট করতে পারবে না , আদিত্যকে অবিশ্বাস করে তাকে অহেতুক ভাবে পারভার্ট হিসেবে দাগিয়ে দিয়ে ! তাছাড়া সমীরও কি ভাববে , যদি সে জানতে পারে আমি আদিত্যর সাথে ছিলাম। নাহঃ নাহঃ , সমীরের এরম অবস্থায় সমীরের অসুস্থ মানসিকতাকে আমি প্রশ্রয় দিতে চাইনা !
এসব ভাবতে ভাবতে সে দেখলো আদিত্যর কোলে চড়ে সে একটি থাকার লজের সামনে এসেছে। সে খানিকটা ইমপ্রেস হলো আদিত্যর স্ট্রেনথ দেখে। অনুরিমা রোগা হলেও ওর তো একটা ভার রয়েইছে। তাকে এতোটা রাস্তা কোলে করে নিয়ে আসা, ..... সত্যিই, একটা সাইলেন্ট সাবাশি আদিত্যর প্রাপ্যই। তাই অনুরিমা মনে মনে তাকে ধন্যবাদ ও কুর্নিশ জানালো। মুখে জানালো না যদি আদিত্য এটার অন্য মানে করে নেয়।
"চলুন , তবে যাওয়া যাক ", অনুরিমাকে আদিত্য বললো।
"হ্যাঁ হ্যাঁ , চলুন ", বলে অনুরিমা আদিত্যর সাথে বেরোতে লাগলো।
আদিত্য গাড়ি স্টার্ট দিলো। মেঘ ঘনিয়ে কালো হয়ে এসছিলো। হঠাৎ করে মেঘ ডেকে উঠলো। অনুরিমা ভয় পেয়ে বললো , "একটু তাড়াতাড়ি চলুন , দেখছেন তো মেঘের কি অবস্থা। সুচরিতা ঠিকই বলেছে , কলকাতার রাস্তায় বাস অটো ট্যাক্সির কোনো মা বাপ্ নেই , কখন যে এরা ভিন্ন ভিন্ন কারণে ঝাঁপি বন্ধ করে দ্যায় তার ঠিক নেই , তা কোনো রাজনৈতিক কারণে হোক বা প্রাকৃতিক কারণে। "
"চিন্তা করবেন না ম্যাডাম , আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব যখন কাঁধে নিয়েছি তখন হাজার বিপর্যয় এলেও আপনাকে ঠিক আমি বাড়ি পৌঁছে দেবো। "
"আমি কথাটা ঠিক ওভাবে বলতে চাইনি। আসলে আপনাকেও তো বাড়ি ফিরতে হবে , আকাশ দেখে মনে হচ্ছে প্রবল বৃষ্টি নামবে। আর অতো বৃষ্টির মধ্যে গাড়ি চালানোটা সেফ নয়। তাই বলছিলাম , যদি আপনি বৃষ্টি নামার আগেই নিজের গন্তব্যে পৌঁছে যান তাহলে সেটা আপনার পক্ষেই ভালো হবে। আমি এসে শুধু শুধু আপনার হেডেক বাড়ালাম। "
"মোটেই না। তুমি হয়তো জানোনা , আমি অনেক এক্সপিরিয়েন্সড ড্রাইভার , সেই কলেজ লাইফ থেকে ড্রাইভিং করি নিজের কার। আমার এই বৃষ্টি বাদলের দিনে বরং ড্রাইভিং করতে ভালোই লাগে , বেশ রোম্যান্টিক একটা ব্যাপার থাকে। ..... বাই দা ওয়ে , আমি তোমাকে তুমি করে ডাকলে অসুবিধা নেই তো ? "
"না না , ঠিক আছে। আমি আপনার থেকে বয়সে এমনিতেও অল্পবিস্তর ছোট , তাই তুমি করে ডাকতেই পারেন। "
"তাহলে তো , তোমাকেও তুমি করে ডাকতে হবে আমায়। সো নো আপনি , ওকে ?"
"আচ্ছা সব ছেলেরাই কেন আপনি থেকে তুমি ডাকটা শুনতে বেশি পছন্দ করে ? "
"এই আবদার বুঝি আগেও অন্য কোথাও থেকে আপনার কাছে এসছে ?"
"আলবাত। ...."
"তা সেই ডাকে কি মিস অনুরিমা সাড়া দিয়েছিলো ?"
"সেটা বড়ো কথা নয় , আগে আমার প্রশ্নের উত্তরটা দেওয়া হোক। ...."
"বাকি ছেলেদের কথা তো বলতে পারবো না , বাট আমি তুমি ডাকটাই বেশি প্রেফার করি , সম্বোধন করতেও আর পেতেও। তাই অফিসের জুনিয়ররাও আমাকে তুমি করে ডাকে , আমিও তাদের তুমিই বলি , উভয় লিঙ্গ বিশেষে ...."
"বুঝলাম , তা এটা কেন ভাবলে যে আমিও সমান সাচ্ছন্দ বোধ করবো ?"
"আমি অতো ভাবিনা , এই যেমন তুমি না ভেবেই আমাকে তুমি করে সম্বোধন করা শুরু করলে , এক্ষুনি বলে উঠলে ভাবলে ইনস্টেড অফ ভাবলেন ......"
"সাবকনশাস মাইন্ডে বলেছি , সেটাও অবজার্ভ করলেন ?"
"সে তুমি যেই মাইন্ডেই বলে থাকো না কেন , যখন বলেই ফেলেছো আর ব্যাক আউট করোনা। তুমিতে স্টিক থাকো। "
"আপনি খুব জেদি দেখছি , সরি তুমি .... হয়তো এই জেদের কারণেই সুচরিতার সঙ্গে সম্পর্ক থাকেনি আপনার , সরি এগেইন , তোমার। ....."
সঙ্গে সঙ্গে আদিত্যর মুখের অভিব্যক্তি বদলে গেলো। সে খানিকটা কড়া গলায় বললো , "তুমি আদেও জানো , কেনো আমার আর সুচির সম্পর্ক ভেঙে গেছিলো ? তুমি হয়তো সুচির ভার্শনটা শুনেছো , আর সেটাকেই সত্যি ভেবে আমাকে এখন অ্যাকিঊস্ করছো ! আমি খারাপ , আমার মা খারাপ , আর তোমার সুচিই একমাত্র ভালো , তাই তো ??"
আদিত্যর গলার আওয়াজে হঠাৎ কঠোরতার প্রকাশ শুনে অনুরিমা বুঝলো দ্যাট সি হ্যাস ডান দা মিস্টেক বাই ক্রসিং হার লিমিট। সে অনুনয় বিনয় করে আদিত্যর কাছে দুঃখ প্রকাশ করতে লাগলো। বোঝাতে লাগলো তার কোনো উদ্দেশ্য ছিলোনা আদিত্যকে হার্ট করার। কিন্তু আদিত্য অতো সহজে মানতে চাইছিলো না। বোঝাই যাচ্ছিলো না জেনে অনুরিমা তাকে অনেক গভীরে আঘাত করেছে। আদিত্য অনুরিমার সাথে কথা কাটাকাটি করতে গিয়ে স্টিয়ারিং থেকে তার মন সরে যায়। ব্যাস , আর কি ! নজর হাটি তো দূর্ঘটনা ঘটি। তাদের সাথেও ঠিক সেটাই হলো। ভুলবশত গাড়িটা গিয়ে ধাক্কা খেলো একটা ল্যাম্প পোস্টে।
ভাগ্য ভালো তাদের দুজনের কোনো আঘাত লাগেনি। কিন্তু অ্যাক্সিডেন্ট দেখে দূর থেকে সাদা ইউনিফর্ম পড়া কলকাতা ট্রাফিক পুলিশের সার্জেন ছুটে এলো। পথচলতি প্রাইভেট গাড়ির এরকম বিপর্যয়ের মতো সুযোগ কি আর সার্জেনরা ছাড়ে। তাঁরা তো বসেই আছে লম্বা চালান কাটার জন্য আর সাধারণ মানুষদের হ্যারাস করার জন্য।
একজন অফিসার দৌড়ে এলো তাদের কাছে। আদিত্যর সাথে বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়লো। অনুরিমা তা দেখে একটু ভয় পেয়ে গেলো। সে আদিত্যকে থামানোর চেষ্টা করছিলো। কিন্তু আদিত্য কোনো কথা শুনছিলোনা। সে ক্রমাগত পুলিশ অফিসারটার সাথে হিটেড আর্গুমেন্ট করে যাচ্ছিলো। ফলে যা হওয়ার তাই হলো , আদিত্যর একটা লম্বা চালান কেটে গেলো। তাছাড়া যেমন ঘোড়া দেখলে মানুষ খোড়া হয় তেমনই দামী গাড়ি দেখলে পুলিশেরও ট্রাফিক নিয়মের কথা বেশি মনে পড়ে। পুলিশ অফিসার আদিত্যকে তার সাথে থানায় যেতে বললো। আদিত্য রাজি হলোনা , তো অফিসার তার গাড়িকে জব্দ করলো, বললো থানা থেকে ছাড়িয়ে আনতে। আদিত্য বললো , তাই হবে। কিন্তু এখন সে থানায় যেতে পারবে না, পরে গিয়ে ছাড়িয়ে আনবে গাড়িটা। কারণ তার কাছে এখন গাড়ির চেয়েও অনেক বেশি গুরুত্ব এই মেয়েটিকে (অনুরিমার দিকে আঙ্গুল করে বললো) এই আবহাওয়ায় নিরাপদে তার বাড়ি পৌঁছে দেওয়া। কথাটা শুনে আদিত্যর প্রতি অনুরিমার মনে শ্রদ্ধার জায়গা তৈরী হলো।
কথামতো অফিসার আদিত্যর কাছ থেকে চাবি নিয়ে গাড়িটাকে সরকারী ভাবে দখল করলো। অনুরিমা ও আদিত্য এবার হাঁটা দেওয়া শুরু করলো। অনুরিমা বারবার আদিত্যকে বলছিলো তার এটা করা উচিত হয়নি , তার এখন গাড়িটাকে রেসকিউ করা নিয়ে ভাবা উচিত ছিল। অনুরিমা ঠিক কিছু না কিছু একটা ম্যানেজ করে বাড়ি পৌঁছে যেত। আর আদিত্যও প্রত্যুত্তরে বারবার এটাই বোঝাচ্ছিলো যে সে কখনোই কোনো মেয়েকে এভাবে মাঝরাস্তায় ফেলে এক পার্থিব বস্তুর পিছনে দৌড়োবে না।
আদিত্যর এসব কথা গুলো অনুরিমাকে একটা ফীল গুড ব্যাপার অনুভব করাচ্ছিল। সে এবার আদিত্যর সাথে অনেক বেশি সহজভাবে কথা বলতে পারছিলো। রাজীবের মতো সেখানে কোনো ট্রিটমেন্টের বাধ্যবাধকতা ছিলোনা। মনে মনে অল্প অনুশোচনাও বোধ হচ্ছিলো এটা ভেবে যে আদিত্য ও সুচরিতার অতীতের বৈবাহিক সম্পর্ক নিয়ে তার ওইরূপ আলটপকা মন্তব্য করা উচিত হয়নি। কিন্তু সে তো শুধু তাই বলেছে যা সে সুচরিতার কাছ থেকে জেনেছে। তাহলে কি সুচরিতা তাকে নিজের ম্যারেড লাইফ নিয়ে ভুল কথা বলেছিলো ? দুই তরফের কথা না শুনে কখনো কোনো জাজমেন্টে আসা উচিত হয়নি তার।
সেই সময়ে অনুরিমার খুব জানতে ইচ্ছে করছিলো কেন আদিত্যর সাথে তার বান্ধবীর বিয়েটা টেকেনি ? এই কথা তো ঠিক যে আদিত্য নিঃসন্দেহে একটা ভালো ছেলে , তার প্রমাণ সে আজ পেয়েছে। তাছাড়া তার প্রাক্তন স্ত্রী সুচরিতাও সবসময়ে তার এক্স-হাসবেন্ড কে নিয়ে যতবার কথা বলেছে ভালো ভালো কথাই বলেছে , যা সত্যিই খুব বিরল ব্যাপার। বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পরও কোনো মেয়ের তার প্রাক্তন স্বামীকে নিয়ে এতোটা রেসপেক্টফুল থাকা , সচরাচর দেখা যায়না। তাই স্বাভাবিকভাবেই মানুষ আদিত্যকে নিয়ে অনুরিমার কৌতূহল ক্রমশ বাড়ছিলো।
সে আদিত্য ও সুচরিতার বিয়ে নিয়ে কথা তুলতেই যাবে কি সঙ্গে সঙ্গে ঝমঝম করে বৃষ্টি নেমে আসলো। তারা তখন এমন একটা জায়গায় ছিল যেখানে কোনো শেড ছিলোনা বৃষ্টি থেকে বাঁচার। এভাবে হঠাৎ করে প্রবল বেগে বৃষ্টি নেমে আসবে সেটা তারা ভাবতে পারেনি। তাদের কাছে ছাতাও ছিলোনা। অনুরিমা প্যানিক করে গিয়ে দৌড়ে কাছের একটি বাস স্টপ ছাউনিতে যেতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে গেলো। আদিত্য অনুরিমা বলে চেঁচিয়ে উঠলো। রাস্তা তখন শুনশান , আসে পাশে কেউ নেই সাহায্য করার। গাড়ি থেকে শুরু করে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট সব নিজের গতি বাড়িয়ে ছুটছিলো , বৃষ্টিতে নিজ নিজ গন্তব্যে তাড়াতাড়ি পৌঁছনোর জন্য। কারোর সময় নেই থামার।
আদিত্য সঙ্গে সঙ্গে অনুরিমাকে কোলে তুলে নিয়ে কাছের সেই বাস ছাউনিতে এসে বসালো। যন্ত্রণায় অনুরিমা কাতরাচ্ছিল। হাত পা বেশ ছিলে গেছিলো , রক্ত বেড়োচ্ছিলো। ব্যাথায় অনুরিমার চোখ দিয়ে জল বেড়িয়ে আসছিলো। আদিত্য মাথা ঠান্ডা রেখে প্রথমে দেখলো কোথায় কোথায় অনুরিমার লেগেছে। তারপর অনুরিমাকে বসতে বলে বৃষ্টি মাথায় নিজে বেড়িয়ে পড়লো কাছে পিঠে কোনো ওষুধের দোকান আছে কিনা সেটা খুঁজতে। বিধাতার অশেষ কৃপায় পেয়েও গেলো একটা কেমিস্টের দোকান। দোকানে গিয়ে তাড়াতাড়ি একটা ফাস্ট-এইড্ এর বক্স কিনলো , সঙ্গে কিছু নেসেসারি ওষুধপত্র যেমন পেইন কিলার ইত্যাদি। সেসব নিয়ে সে আবার ছুট দিলো অনুরিমার উদ্দেশ্যে।
বাস স্টপে পৌঁছে আদি ফাস্ট-এইড বক্স এর সাহায্যে অনুরিমার সাময়িক শুশ্রুষা করতে লাগলো। বন্ধু নয় , যেন স্বামীর কর্তব্য সে পালন করছিলো। আদিত্যর বিরামহীন যত্নে অনুরিমার একটু আরাম অনুভব হচ্ছিলো। সে মনে মনে সমীরকে কল্পনা করছিলো কিন্তু বাস্তবে সেই কার্য আদিত্য করছিলো। যখন সে সেটা বুঝতে পারলো তখন সে নিজেকেই প্রশ্ন করলো যে সমীর কি কোনোদিনও তার এভাবে যত্ন নিয়েছে , যতটা যত্ন একটা অজানা অচেনা পুরুষ কয়েকদিনের আলাপেই নিচ্ছে। সে চাইলেই তো নিজের গাড়ির পিছনে ছুটতে পারতো ! তা না করে সে আমার সাথে এলো , একসাথে বৃষ্টিতে ভিজলো। ভিজতে ভিজতে আমার জন্য ওষুধ আনতে গেলো। এখন আমার শুশ্রুষা করছে। ইস্সস ! কত ভালোই না হতো যদি এসবকিছু আদিত্যর বদলে সমীর করতো।
মনে মনে অনুরিমা বলে উঠলো , "সমীর তুমি কোথায় ? বারবার কেন এমন হয় , যে যা আমি তোমার কাছ থেকে এক্সপেক্ট করি তা আমাকে অন্য কেউ দিয়ে যায়। আমি তো এসব কিছু তোমার কাছ থেকে চাই। তোমার সাথে বৃষ্টিতে ভিজতে চাই , তোমার সাথে ফাঁকা সিনেমা হলে চুম্বনে লিপ্ত হতে চাই , আর তুমি কিনা আমাকেই অন্য কারোর সাথে কল্পনা করো , ছিঃ !"
মনে মনে এসব ভেবে অনুরিমা কেঁদে উঠলো। আদিত্য ভাবলো এটা তার শারীরিক ব্যাথার কান্না , যে ব্যাথা সে কিছুক্ষণ আগে পড়ে গিয়ে পেয়েছে। কিন্তু না , এ ব্যাথা তো আসলে মনের। জীবনে অপূরণীয় আকাঙ্খা নিয়ে অনুরিমার কোনো অভিযোগ নেই। অভিযোগ তার এটাই যে সেইসব অপূরণীয় আকাঙ্খা তার পূরণ হচ্ছে অন্য পুরুষদের দিয়ে , তার স্বামীর দ্বারা নয়। সেটা তাকে আরো ব্যাথিত করে তুলছে।
বৃষ্টি ভেজা মুখেও অনুরিমার চোখের জল বুঝে নিতে আদিত্যর অসুবিধা হয়নি। সে ঠিক বুঝতে পারছে অনুরিমা কাঁদছে। তাই সে খুবই নরম গলায় আদরভরা স্নেহে জিজ্ঞেস করে উঠলো , "ব্যাথা করছে ?"
ভাবনার আকাশে মেঘ সরে গিয়ে সে বাস্তবতার আলো দেখতে পেলো। নিজেকে সামলে নিয়ে অনুরিমা বললো , "হ্যাঁ , ওই একটুখানি।"
অনুরিমা আদিত্যকে বুঝতে দিলোনা তার চোখে জলের পিছনে আসল কারণ। বৃষ্টিটা তখন একটু লেগে এসছিলো। তবু রাস্তা ছিল কাঁদাময় , এবং ফুটপাথ শ্যাওলাময়। অনুরিমা আদিত্যর হাত ধরে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলো। উঠতে পারলো , কিন্তু চলতে পারছিলো না তখন। আদিত্য বললো এখন আবার পা পিছলে পড়লে সে আর উঠতেও পারবে না। এই বলে আদিত্য কিছু জিজ্ঞেস না করেই অনুরিমাকে নিজের কোলে তুলে নিলো। অনুরিমা অবাক হয়েগেলো। আদিত্য কোলে করে তাকে কোথায় নিয়ে যাবে ? বাড়ি যে এখনও অনেক দূর।
রাস্তাটা তখনও বেশ ফাঁকাই ছিল। দু-চারজন লোক বেরিয়ে ছিলো। কিন্তু তাদেরও তো চোখে পড়ছিলো যে ফুটপাথ দিয়ে বৃষ্টি ভেজা রাস্তায় একটা ছেলে একটি মেয়েকে সিনেমার মতো কোলে তুলে নিয়ে কোথাও একটা যাচ্ছে। অনুরিমা লজ্জায় ছটফট করতে লাগলো। আদিত্যকে অনুরোধ করতে লাগলো তাকে নামিয়ে দেওয়ার জন্য। আদিত্য তাকে ওয়ার্নিং দিলো , এরকম করলে অনুরিমা নিজেও পড়বে তাকেও ফেলবে। তারপর দুজনের কোমড় ভাঙবে। তখন কে কাকে সাহায্য করবে ? সে যা করছে তা অনুরিমার ভালোর জন্যই করছে। এই অবস্থায় অনুরিমা ভেজা পিচ্ছিল রাস্তায় হেঁটে যেতে পারবে না। পরিস্থিতিটা একটু অনুরিমা বোঝার চেষ্টা করুক।
অনুরিমা তখন জিজ্ঞেস করলো এইভাবে সে তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে ? বাড়ি তো এখন অনেক দূর ! আদিত্য বললো ওষুধ আনতে গিয়ে সে একটি ইন্ লজ দেখে এসছে। এখন তারা সেখানে যাচ্ছে। এভাবে বাস স্টপে কতোক্ষণ আর বসে থাকবে ! কোনো বাস পাওয়া যাচ্ছে না, পেলেও সেই বাসে খুব ভীড় থাকবে , যেখানে অনুরিমা চাইলেও উঠতে পারবে না এই পা নিয়ে। সব ট্যাক্সি নিজেদের মিটার বন্ধ করে গাড়ি গ্যারেজ করে দিয়েছে। তাই এখন হেঁটে হেঁটেও বাড়ি ফেরা যাবেনা। তার চেয়ে বরং একটি লজে কিছুক্ষণ স্টেই করে অনুরিমা বিশ্রাম নিক। ব্যাথা কিছুটা ঠিক হলে , এবং রাস্তায় গাড়ি চলাচল স্বাভাবিক হলে তখন কোনো শাটল্ বা গাড়ি ভাড়া করে আদিত্য অনুরিমাকে নিরাপদে বাড়ি পৌঁছে দেবে।
আদিত্যর সাথে কোনো লজে সময় কাটাতে তার মন তো চাইছিলো না , কিন্তু আর তো কোনো উপায়ও ছিলোনা। আদিত্যর অকাট্য যুক্তিকে কোনো এক্সকিউস দিয়ে খণ্ডন করা যাচ্ছিলো না। সে ভাবলো একবার সমীরকে ফোন করে আসতে বলবে। সেই মতো অনুরিমা তার ছোট হ্যান্ডব্যাগ থেকে ফোনটা বার করলো। ওমাহঃ ! দেখলো তখন পড়ে যাওয়ার সময়ে ব্যাগ সমেত ফোনটা জলে পড়ে যাওয়ায় ফোনটা ডেড হয়েগেছে ! শিট্ ! বিপদ যখন আসে তখন চারদিক থেকে সকল বিপদ একসাথে গ্যাং আপ করেই আসে। একবার ভাবলো যে আদিত্যর কাছে ফোন চেয়ে সে সমীরকে কল করবে। কিন্তু আদিত্য কি ভাববে ? আদিত্য ভাববে যে অনুরিমাকে তাকে বিশ্বাস করছে না ! একেই সে তার আর সুচরিতার বৈবাহিক সম্পর্ক নিয়ে দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য করে যথেষ্ট লজ্জিত , আর সে নিজেকে ছোট করতে পারবে না , আদিত্যকে অবিশ্বাস করে তাকে অহেতুক ভাবে পারভার্ট হিসেবে দাগিয়ে দিয়ে ! তাছাড়া সমীরও কি ভাববে , যদি সে জানতে পারে আমি আদিত্যর সাথে ছিলাম। নাহঃ নাহঃ , সমীরের এরম অবস্থায় সমীরের অসুস্থ মানসিকতাকে আমি প্রশ্রয় দিতে চাইনা !
এসব ভাবতে ভাবতে সে দেখলো আদিত্যর কোলে চড়ে সে একটি থাকার লজের সামনে এসেছে। সে খানিকটা ইমপ্রেস হলো আদিত্যর স্ট্রেনথ দেখে। অনুরিমা রোগা হলেও ওর তো একটা ভার রয়েইছে। তাকে এতোটা রাস্তা কোলে করে নিয়ে আসা, ..... সত্যিই, একটা সাইলেন্ট সাবাশি আদিত্যর প্রাপ্যই। তাই অনুরিমা মনে মনে তাকে ধন্যবাদ ও কুর্নিশ জানালো। মুখে জানালো না যদি আদিত্য এটার অন্য মানে করে নেয়।